১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। কিন্তু এদিনে ১৯৮৩ সালে ঢাকায় ঝরেছিল শিক্ষার্থীদের রক্ত। এ জন্য অনেকে এ দিনটিকে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকেন।
Advertisement
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীদের আরেকটি বড় আন্দোলন ও আত্মাহুতির নজির ছিল এই ১৪ ফেব্রুয়ারি। তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পরের বছরই মজিদ খান প্রণীত শিক্ষানীতির বিরোধিতা করেন শিক্ষার্থীরা। এসএসসি কোর্স ১২ বছর, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও শিক্ষার ব্যয়ভার যারা ৫০ শতাংশ বহন করতে পারবে তাদের রেজাল্ট খারাপ হলেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার মতো কথাও বলা হয়েছিল এ শিক্ষানীতিতে।
১৯৮২ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন, কালক্রমে যেটি গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। তখনকার ১১টি প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, ছাত্রবন্দীদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধ এবং গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেয়। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী আকাশকাঁপানো স্লোগানে এদিন নেমে আসেন রাজপথে।
Advertisement
সেদিন শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। উত্তেজনার একপর্যায়ে ছাত্রনেতারা ব্যারিকেডের কাঁটাতারের ওপরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেন। তখন কোনো রকম উসকানি ছাড়াই রায়ট কার ঢুকিয়ে গরম পানি ছিটাতে শুরু করে পুলিশ। এরপর লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করে। তা করতে ব্যর্থ হয়ে নির্বিচারে গুলি শুরু করে। এতে প্রথমেই গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে গেলে পুলিশ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে হত্যা করে। ওইদিনই শিশু একাডেমিতে যোগ দিতে আসা দীপালী নামের এক শিশু গুলিতে নিহত হয়। পুলিশের দীপালীর মরদেহ গুম করে ফেলে। তাছাড়া যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, পল্টন এলাকায় আরো অনেককেই গুম করা হয় বলে স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। আন্দোলনে জাফর, কাঞ্চনসহ মোট ১০ জন শহীদের হদিস পাওয়া যায়।
এর পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান কাঞ্চন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যেনো বেগবান না হয় সেজন্য স্বৈরাচার শাসকের বিরুদ্ধে আরও অনেক লাশ গুম করে ফেলার অভিযোগ ওঠে।
তখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হিসেবে এখনকার মতো পালন করা হতো না। ১৯৮৩ সালের সেই দিনটি ছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলনে একটি চরম মুহূর্ত।
সেদিনের সেই মিছিলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কর্মী তসলিমা রানা নীলা। তসলিমা রানা নীলা বলেন, ‘সেদিন সকাল ১০টায় বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্রদের জমায়েত হবার কথা। সেখান থেকে শিক্ষানীতি প্রত্যাহারের দাবিতে স্মারকলিপি নিয়ে শিক্ষা ভবনে যাওয়া হবে।’
Advertisement
‘সকাল ১০টায় বটতলা থেকে মিছিল নিয়ে আমরা শিক্ষাভবনের দিকে যাচ্ছি। যখন আমরা কার্জন হল আর শিশু একাডেমির মাঝখানের রাস্তাটায় এলাম, তখন আমরা প্রথম আওয়াজ শব্দ শুনি। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, সেখানে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। তখন রীতিমতো গোলাগুলি হচ্ছে।’
তসলিমা রানা নীলা বলেন, ‘আমরা দৌড়ে কার্জন হলে ঢুকে গেলাম। ওখানে বেশ কয়েক ঘণ্টা থাকলাম। তারপর বিকালের দিকে যখন অবস্থাটা একটু স্বাভাবিক হলো, তখন আমরা আমার বটতলায় চলে এলাম।’
তিনি বলেন, ‘তখন শহরের অবস্থা ছিল খুবই থমথমে। আমরা বটতলায় জমায়েত হওয়ার পর জয়নালের মৃতদেহ ট্রাকে করে সেখানে আনা হলো। তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আখতারুজ্জামান বক্তৃতা দিচ্ছেন, এমন সময় আমরা হঠাৎ শুনতে পেলাম নতুন আনা রায়ট কারের শব্দ। সেটি রঙিন পানি ছিটাচ্ছে, যাতে ছাত্রদের পরবর্তীতে সহজেই চিহ্নিত করা যায় আর গ্রেফতার করতে তাদের সুবিধা হয়।’
‘আবার ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কলাভবনের পেছন দিক দিয়ে আরও অনেকের মতো আমিও দৌড়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় পেছনের ধাক্কায় আমি পড়ে যাই। আমার উপর দিয়ে অনেক ছাত্ররা চলে যায়, আমিও অনেক ব্যথা পাই। একটা সময় অর্ধ চেতন অবস্থায় আমি নিজেকে আবিষ্কার করি, আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে’,- বলছেন তসলিমা রানা নীলা।
সাবেক ছাত্রনেতা ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মোশতাক হোসেন সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি অনেক মৃতদেহ পুলিশ ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে। শুধু জয়নাল নামের একজন ছাত্রকে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে সেই মৃতদেহ বটতলায় নিয়ে এসে আমরা বিক্ষোভ করি।’
‘সেদিন পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫০জন নিহত হয়েছিল বলে আমরা ধারণা করি। কিন্তু দুজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাকি মৃতদেহগুলো গুম করে ফেলে। তাদের স্বজনরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে স্বজনদের কোন খোঁজ আর পাননি,’- বলেন তিনি।
তবে হতাহতের এই সংখ্যার বিষয়ে তখন সরকারিভাবে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি।
‘সেদিন থেকে এই দিনটিকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে বলা হয়’, বলছেন হোসেন।
বিকেলে এবং পরের দিনও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলে বলে তিনি জানান। পুলিশ অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়। মোশতাক হোসেনকেও গ্রেফতার করা হয়।
তিনি জানান, জয়নাল ছাড়া পরে মোজাম্মেল আইয়ুব নামের আরেকজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। জাফর, কাঞ্চন, দীপালি সাহা নামের একটি ছোট বাচ্চাসহ অনেকে নিখোঁজ হয়ে যায়, যাদের পরে আর কোন খোঁজ মেলেনি।
এর কিছুদিন পরে সরকার একটি ঘোষণা দিয়ে শিক্ষানীতিটি স্থগিত করে।
জেডএ/জেআইএম