কোন সমস্যার সমাধান খুঁজতে হলে কিংবা ওই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে হলে অবশ্যই সমস্যার গোড়ায় চোখ দিতে হবে। যেমন, কোন গাছকে বাঁচাতে হলে গাছের শেকড়ে পানি না ঢেলে যদি গাছের আগায় পানি ঢালি, তবে কি ওই গাছকে বাঁচানো সম্ভব? নিশ্চয়ই না। কারণ এখানে স্পষ্ট এবং একটি বিষয় পরিষ্কার যে, গাছও এক ধরনের জীব। গাছও আমাদের মতই আহার করে। আমরা মুখ দিয়ে খাবার খাই, গাছ খাবার গ্রহণ করে শেকড়ের মাধ্যমে। তাই গাছের শেকড়ে পানি না ঢেলে গাছের কোন অংশে পানি ঢাললে গাছের দেহে ওই পানির অস্তিত্ব মিলবে না।
Advertisement
গাছ, শেকড় ও পানি- তিনটি বিষয়ের উদাহরণ এজন্যই টানলাম, আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে। গাছটিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধরে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হিসেবে ধরে এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাকে পানি হিসেবে ধরে সামনে আগানো যাক।
গণমাধ্যমের খবরে জানলাম, সরকার কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করেছে প্রশ্ন ফাঁস রোধ করতে। বিষয়টি আমার কাছে ধোঁয়াশার মতো মনে হচ্ছে। কারণ আমাদের দেশের নদীতে ইলিশ ধরার জন্য কারেন্ট জাল নামে একপ্রকার জালের প্রচলন আছে। এ জালে মাছ বেশি আটকা পড়ে। তাই গরিব জেলেরা লোভে হোক, লাভে হোক ইলিশ ধরতে এ জাল ব্যবহার করে। এখন কথা হচ্ছে, এ কারেন্ট জালগুলো কোথায় উৎপাদন হয়? কোথা থেকে আসে? যদি দেশের বাইরে থেকে আসে, তাহলে আমদানি বন্ধ করতে হবে। আর যদি দেশে উৎপাদন হয়, তাহলে সে কারখানা বন্ধ করতে হবে।
> আরও পড়ুন- স্কাউটিংয়ে রাষ্ট্রপতি অ্যাওয়ার্ড পেলেন রাকিব
Advertisement
আবারও গাছের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। স্কুল জীবন পার করে কলেজ জীবনে পা রাখি। ভর্তি হয়েই দু’তিন মাসের মাথায় পরীক্ষা। ক’দিনই বা ক্লাস হলো? ভর্তি কার্যক্রম শেষ হতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে মাসখানেক সময় এমনিতেই যায়। তাহলে পড়াশোনা কবে হলো? ক্লাসে শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের বন্ধন তৈরি হতেও তো সময় লাগে। সে পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কোনভাবেই পড়াশোনা জমে না। কোনমতে সহপাঠীরা পরীক্ষা দিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লো। জানি সামনে কী হবে? বই আছে, শিক্ষক নেই। সেই শূন্যস্থান কিভাবে পূরণ হবে?
জেলার সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের কথা বলছি। এ কলেজে শিক্ষকের চেয়ে দ্বিগুণ বিষয়ের বই শিক্ষার্থীদের পাঠ করতে হয়। তাহলে যে বিষয়ে শিক্ষক নেই, ওই বিষয়ের শিক্ষার্থীরা কিভাবে শূন্যস্থান পূরণ করবে? নিশ্চয়ই সে শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়তে হবে। যাকে আমরা আজ কোচিং বাণিজ্য বলছি। একজন ছাত্র হিসেবে দেখেছি, শিক্ষক নয়, শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রয়োজনেই স্যারদের পেছনে পেছনে ঘোরে। কারণ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। একজন শিক্ষক কীভাবে দুই-তিনশ’ ছাত্রছাত্রীকে সামলান? তাদের সামলাতে গিয়ে পড়াশোনাই বা কতটুকু হয়।
এই যে এখানে শিক্ষক কম, ছাত্র বেশি; সেদিকে কি কারো খেয়াল আছে? এজন্যই বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের পেছনে পেছনে ঘুরে প্রাইভেট ব্যাচ ধরে। আমি নিজেও একজন ভুক্তভোগী। দুই বছরের সেশনে ক্লান্ত। ঠিকমত দেড় বছরও হয় না। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর পাঁচ-ছয় মাস আগে থেকেই পরীক্ষার্থীদের ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। এই যে অবসর, এ সময়ে কি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য বিকল্প কোন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?
> আরও পড়ুন- মনের অন্ধকার দূর করে বই
Advertisement
আমি বলতে চাই- আজকে যে এই পড়াশোনাকে কোচিং বাণিজ্য বলে শিক্ষকদের ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে, তা কি ঠিক হচ্ছে? কোচিং বাণিজ্য হলো, একটি কোচিং সেন্টারে শুধু শত শত শিক্ষার্থী একসাথে ক্লাস করতে যাবে আর সেখান থেকে শিক্ষক মোটা অংকের অর্থ আয় করে দালান-কোটা গড়ে তুলবেন। কিন্তু যেখানে দশ-বারো জন শিক্ষার্থীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে পড়ালেখা শেখানো হয়, সেটাকে কিভাবে আমরা কোচিং বাণিজ্য বলি?
অনেক কোচিং শিক্ষক আছেন; যাদের দেখি বিনা পারিশ্রমিকে অসংখ্য ছেলে-মেয়েকে পড়িয়ে মানুষ করছেন। অনেক শিক্ষক আছেন; যারা বেতন পান না, মাস শেষে সংসারের খরচ, ছেলে-মেয়েদের ভরণ-পোষণ, পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে রীতিমত দুশ্চিন্তায় ডুবে আছেন।
তবে আমি কোচিং বাণিজ্যের পক্ষে নই। আমিও এর চরম বিরোধিতা করি। তো, কখন এই কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করবেন? তার আগে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সমৃদ্ধ করতে হবে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, বোনাস নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক সংকট দূর করতে হবে। সঠিক পরিচর্যায় পড়াশোনা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে এমনিতেই কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
> আরও পড়ুন- বাদাম বিক্রির টাকায় ভাইকে পড়াচ্ছেন মোজাহার
একটি কথা পরিষ্কার যে, প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে কোচিং সেন্টার বন্ধ নয়। বরং প্রয়োজনে উচ্চতর মহলে নজর দিতে হবে। তাহলেই প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী, লক্ষ্মীপুর।
এসইউ/এমএস