আন্দিজ পর্বতমালায় উৎপত্তি, তারপর কলম্বিয়ার উর্বর জমির ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে এই নদী চলে গেছে ক্যারিবীয় সাগর পর্যন্ত। কাউকা নদী এক হাজার ৩৫০ কিলোমিটারে দীর্ঘ, একটা পর্যায়ে এটি এসে মিশেছে ম্যাগডালেনা নদীর সঙ্গে।
Advertisement
ধারণা করা হয়, এই নদীর তীরে বাস করে প্রায় এক কোটি মানুষ। কলম্বিয়ার মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ।
এই দীর্ঘ যাত্রাপথে কাউকা নদীর ওপর রয়েছে অনেক হাইড্রোইলেকট্রিক বাঁধ। নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে অনেক শিল্প-কারখানা, নগর-বন্দর-গ্রাম। লাখ লাখ কৃষক আর মৎস্যজীবীর জীবন চলে এই নদীর ওপর নির্ভর করে।
গত বছরের মে মাসে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছিল কলম্বিয়ায়। নদীর একটা জায়গায় একটা বিরাট বাঁধ দেয়া হচ্ছিল। এই বাঁধ নির্মাণের সময় সেখানে একটা বড় ত্রুটি দেখা দিল। সেটির কারণে ভাটিতে হঠাৎ বন্যা হলো। হাজার হাজার মানুষ সেই বন্যায় তাদের বাড়ি-ঘর ছাড়তে বাধ্য হলো।
Advertisement
কিন্তু এরপর যা ঘটলো তা বেশ নাটকীয়। এই বিরাট নদী যেন উধাও হয়ে গেল। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাউকা নদীর পানি এতটাই শুকিয়ে গেল যে, স্থানীয় হাইড্রোলজিস্টরা বলছেন, তারা এই নদীর পানিও আর মাপতে পারছেন না।
কাউকা নদীর ভাগ্যে কী ঘটেছে
কলম্বিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পুয়ের্তো ভালডিভিয়া এবং ইটুয়াংগো শহরের কাছে তৈরি হচ্ছে এক বিরাট হাইড্রো-ইলেকট্রিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সেটির জন্য সেখানে কাউকা নদীতে বাঁধ দেয়া হচ্ছে।
এই নির্মাণ কাজটি করছে ইপিএম নামে একটি কোম্পানি। কাউকা নদীর পানি ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য তারা প্রথমে তিনটি টানেল তৈরি করে।কিন্তু গত বছরের মে মাসের শুরু থেকে সেখানে সমস্যা দেখা দেয়। ৭ মে সেখানে পানি ভিন্ন খাতে নেয়ার জন্য তৈরি টানেলের কাছে একটি বিরাট খাদ তৈরি হয়। একই সঙ্গে ভূমিধস শুরু হয়। ফলে টানেলগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। প্রকৌশলীরা অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেননি।
Advertisement
পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাঁধের অপর পাশে পানির চাপ বাড়তে থাকে। এই চাপ কমানোর কোনো উপায় তখন আর ছিল না। ফলে পুরো জলাধার পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ইটুয়াংগো বাঁধ। কলম্বিয়ার সবচেয়ে বড় হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রকল্প হওয়ার কথা ছিল এটি। কিন্তু পুরো দেশের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করল এই বাঁধ
১০দিন পর প্রচণ্ড পানির চাপে একটি টানেলের মুখ আবার খুলে যায়। এরপর এতটাই তীব্র বেগে ওই টানেল দিয়ে পানি ছুটতে থাকে যে, তা ভাটিতে ব্যাপক বন্যা তৈরি করে। ২৫ হাজার মানুষকে তখন জরুরি ভিত্তিতে তাদের বাড়িঘর থেকে সরিয়ে নিতে হয়।
কিন্তু হিড্রোইটুয়াংগো বাঁধের সমস্যা আরও জটিল রূপ নিল। পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হলো। বাঁধের উপরের দিকটায় অনেক পলি জমল। ফলে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে বাঁধের উপর দিয়ে পানি উপচে পড়তে লাগল। পুরো বাঁধটি তখন দুর্বল হয়ে গেল।
প্রকৌশলীরা আশঙ্কা প্রকাশ করলেন যে, পুরো বাঁধটি এখন ধসে পড়তে পারে। প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার মানুষকে সতর্কাবস্থায় রাখা হলো।
বন্যা থেকে খরা, তারপর পুরো নদী উধাও
কীভাবে এই বাঁধের ধস ঠেকানো যায়, তখন থেকে সেটিই সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পেতে লাগল। যেহেতু টানেলগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে গেছে ভূমিধসে, তাই নদীর পানি ছাড়ার উপায় একটাই। তাহলো জলাধারের উচ্চতায় পানি পৌঁছানোর পর কিছু ফ্লাডগেট তৈরি করে সেখান দিয়ে এই পানি ছাড়া।
কিন্তু যখন শুকনো মৌসুম শুরু হলো, তখন পানির উচ্চতা নেমে গেল অনেক নিচে। ফলে নদীর অপরপাশে পানি ছাড়ার কোনো উপায় আর রইল না।
পানি কমতে থাকায় এ বছরের ১৬ জানুয়ারি অপরপাশে অবমুক্ত করার পানির পরিমাণ নেমে আসল প্রতি সেকেন্ডে মাত্র ৩৯৫ কিউবিক মিটারে। আর ৫ ফেব্রুয়ারি একদম বন্ধ হয়ে গেল পানির স্রোত।
এক সপ্তাহের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল কাউকা নদী।
পুয়ের্তো ভারডিভিয়া শহরের কর্মকর্তারা ৪ ফেব্রুয়ারি নদীতে পানির গভীরতা পেয়েছিলেন ১ দশমিক ৯৬ মিটার। ৫ ফেব্রুয়ারি তা কমে দাঁড়ালো ৪২ সেন্টিমিটারে।
যেখানে একসময় ছিল এক প্রমত্তা নদী, সেখানে এখন কেবল পাথর আর কাদা। হাজার হাজার মাছ সেখানে পানির অভাবে ছটফট করছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা সেসব মাছ ধরে তাদের প্রাণে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
নদীর পানি পরিমাপের কাজ করেন যে প্রকৌশলীরা, তারা বলছেন, পানির স্রোত এখন এতটাই ক্ষীণ যে, তাদের যন্ত্রে আর সেটি মাপা যায় না। তাদের যন্ত্রের রিডিং হচ্ছে- শূন্য।
আর নদীর ভাটিতে এতদিন যারা বন্যার আশঙ্কার মধ্যে ছিলেন, এবার তারা খরায় আক্রান্ত। তাদের জমিতে সেচ দেয়ার পানি নেই। মাছ ধরার উপায় নেই। কতদিন এ অবস্থা চলবে, কবে আবার নদী তার স্রোত ফিরে পাবে? কেউ বলতে পারছেন না।
সূত্র : বিবিসি বাংলা জেডএ/এমকেএইচ