প্রবাস

প্রযুক্তির কল্যাণে ভাটা পড়েছে আবেগে

একটা সময় ছিল, যখন দেশ থেকে প্রবাসীদের চিঠি কিংবা রেকর্ড করে ক্যাসেট দেয়া হত। পত্র লেখার সময় পরিবারের সবাই আবেগ নিয়ে বসতেন টেবিলে, তারপর লেখালেখি। যিনি লিখতেন তার পাশে বসে অন্যরা মনে করিয়ে দিতেন গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো। আর এখন চোখের পলকেই ছড়িয়ে যাচ্ছে তথ্য। তবে আগেকার সেই আবেগ-অনুভূতি বিলুপ্তির পথে। প্রযুক্তির কল্যাণে যেন ভাটা পড়েছে প্রবাসীর আবেগে।

Advertisement

যখন অডিও ক্যাসেট রেকর্ড হত প্রবাসীদের পাঠানোর জন্য, আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হত ফ্যামিলিতে। আমাদের সেই আবেগের নানা দিকগুলোতে এখন লেগেছে প্রযুক্তির ছোয়া, চিঠির স্থান দখলে নিয়েছে এসএমএস আর অডিও ক্যাসেট রেকর্ডের বদলে ভিডিও কল, কিংবা বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে ভয়েস রেকর্ড পাঠানো যখন তখন, দিন-দুপুর কিংবা সকাল-সন্ধ্যা।

প্রযুক্তি ফলে যোগাযোগ সহজলভ্য হওয়ায় আবেগ অনুভূতির জায়গাতেও কিছুটা ভাটা পড়েছে বটে তবে প্রবাস জীবনটা আগের মতই রয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী আলোচিত একটি শব্দ প্রবাস। ‘আমার আগের লেখায় এই সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কুল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হয় মহাসাগরে ডুবে থাকার নামই প্রবাস জীবন।

প্রবাসী হলো চোখ বন্ধ করে কষ্ট সহ্য করার একটি ক্ষেত্র। দিনভর কাজ করে রান্না করার বিচিত্র অভিজ্ঞা অর্জন যার সঙ্গী, সেনাবাহিনীর মতো নিয়মমাফিক জীবন-যাপন যার নিত্য কর্মসূচি, শত বঞ্চনায় যার মুখে থাকে আপনজনকে সুখে রাখার এক চিলতে মিছে হাসি। সেই তো প্রবাসী। ধু ধু মরুর বুকে নিরলস কাজ করেও প্রবাসীরা থেমে থাকে না।

Advertisement

হাতে লেখা চিঠি দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছে যায়। এখন চিঠি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া-আসা করে না। আর হয়তো কখনও চিঠির মাধ্যমে কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলবে না, প্রিয় সুরভী, গতকাল তোমার চিঠি পেয়েছি। তোমার সুন্দর হাতের লেখা কতদিন পর পেলাম।

মা তার প্রবাসী সন্তানকে বলবে না বাবা পৌঁছে একটা চিঠি দিয়ো। কিংবা ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো। নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখতে ভুল করিস না। চিঠিপত্র আদান-প্রদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটির নাম ডাকপিয়ন। খাকি রঙের পোশাকে টুং-টাং বেলের শব্দে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয় রানার।

প্রবাসে থাকা ছেলের পাঠানো টাকা, নববধূর কাছে লেখা স্বামীর চিঠি ইত্যাদি মানুষের দোরগোড়ায় নির্ভুলভাবে পৌঁছে দেয় ডাকপিয়ন। রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর মাস শেষে যে সামান্য কিছু টাকা মাসোয়ারা পায়, তা দিয়েই ডাকপিয়ন পরিবার-পরিজন নিয়ে জীবন চালায়। ডাকপিয়ন যাতে তার কাজটা দ্রুত গতিতে করতে পারে সেজন্য দরকার হয় ডাকঘরের।

প্রবাসী কাজ করবে খরা রৌদ্রের, প্রচণ্ড শীতে ১০ ঘণ্টা, ১২ ঘণ্টা এমনকি ১৪ ঘণ্টাও। এর চেয়েও বেশি। নিয়মের বাইরে যাওয়ার তার সুযোগ নেই। মায়ের মৃত্যুতেও সে দেশে যেতে পারবে না চাইলেও, কারণ সুনির্দিষ্ট একটি বিধিতে মিলবে ছুটি। প্রবাসী মরলেও তার লাশ নিয়ে কত বিড়ম্বনা। কত আনুষ্ঠানিকতার পর সেটা দেশে যাবে। জীবনের সিংহভাগ কাটিয়ে অনেক প্রবাসীর শেষ নিঃশ্বাসটা যায় প্রবাসে, থাকে না কোনো আপন জন।

Advertisement

শত মান অভিমান বুকে ধারণ করেই পৃথিবীকে বিদায় জানায় অনেকটা নিঃসঙ্গভাবেই। যে মানুষগুলোর জন্য এত আয়োজন, এত শ্রম, ত্যাগ আর ভালোবাসা সেই প্রিয় মানুষগুলো এই অন্তিম মুহূর্তে উপস্থিত থাকতে পারে না। না ইচ্ছা করে নয়, বাস্তবতার কারণেই আপনজনকে কাঁদতে হয় হাজার মাইল দূরে বসে। বাবা কাঁদে, কাঁদে গর্ভধারিণী মা। ভাই বোন ও আত্মীয়-স্বজন কিন্তু এখন সেই কান্না তো আর পৌঁছায় না।

বাড়ি থেকে ফোন এসেছে, বড় ইচ্ছা হয় ফোন রিসিভ করব কিন্তু আমিতো কাজেই আছি, ধরব কিভাবে, সাইটে কাজ করছি, বস জানতে পারলেই চাকরি শেষ। আমি অসুস্থ, ইচ্ছা হয় না কাজে যেতে একদিন, এত মাথা ব্যথা নিয়ে কীভাবে যায়, কিন্তু হঠাৎ অফিস থেকে আসল কল, যেতে হবেই, নইলে কাটবে স্যালারি। এ রকম অসংখ্য জরুরি মুহূর্তেও প্রবাসীকে নিয়তি মেনে নিতে হয়।

এই মেনে নেয়ায় যেন তার ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপর আমরা প্রবাসী সুখ বিলিয়ে দিই, কষ্ট সহ্য করেও হাসি ফোটাই। শত শত বেদনার কাহিনি আমাদেরকে দাবাতে পারে না। কাজ শেষে রুমে এসে আমরা বিভিন্ন বিনোদনমূলক কাজের কষ্টগুলো ভুলে যায়। ফাঁকে ফাঁকে সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো আমাদের কাছে নিয়ে আসে দেশীয় আবেগ।

এখন আর কেউ চিঠি লিখে তার মনের ভাব প্রকাশ করে না। কোনো খবর জানা বা জানানোর জন্য চিঠির ওপর ভরসা করে কেউ বসে থাকে না। কারণ তা ইন্টারনেট তথা ইমেইলের মাধ্যমেই সবাই জেনে নেয়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে খবর পৌঁছে দেয়া যায়।

প্রেমিক-প্রেমিকারা তাদের মনের কথাগুলো লিখে মোবাইলে এসএমএস করে পাঠিয়ে দেয়। সেকেন্ডের মধ্যেই বার্তাটি আমরা আমাদের মোবাইলের ইনবক্সে পেয়ে যাচ্ছি। এ ছাড়া আমাদের ফেসবুকের বন্ধু লিস্টে যারা আছে, তাদের সবকিছুই ফেসবুকের মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি প্রতি মুহূর্তে।

অতিথি লেখক/ মুহাম্মদ আবদুস শাকুর, শারজা, আরব আমিরাত

এমআরএম/জেআইএম