একুশে বইমেলা

সাহিত্যমান বাড়াতে আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন দরকার

ফরিদ আহমেদ, সভাপতি জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতি এবং স্বত্বাধিকারী সময় প্রকাশন। অমর একুশে বইমেলার প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। এ সময় মেলার ব্যবস্থাপনা, সাহিত্যমান এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন।

Advertisement

বাংলা সাহিত্যের মান বাড়লেও বিশ্ব মানের কী-না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন এই প্রকাশক। এ অবস্থা উত্তরণে লেখক, প্রকাশকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : দ্বিতীয় সপ্তাহে গড়াল অমর একুশে বইমেলা। এবারের আয়োজন কেমন দেখছেন?

ফরিদ আহমেদ : প্রকাশক এবং আয়োজকদের পক্ষ থেকে এই মেলাকে সব সময় ইতিবাচকভাবেই দেখে থাকি। এবারের মেলাকে সফল করতে কিছু ভালো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে মেলার কাঠামোর পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এই পুনর্বিন্যাস করতে গিয়ে কিছু বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। সেই বিবেচনায় মনে হয়, এবার মেলার কাঠামো ভালো হয়েছে।

Advertisement

দ্বিতীয়ত, বইমেলায় দেশের আর্থ-সামাজিক বিষয়টিও প্রভাব ফেলে। এবারে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।

জাগো নিউজ : কাঠামোর পুনর্বিন্যাসের কথা বললেন। আসলে কী পরিবর্তন এলো?

ফরিদ আহমেদ : গত বছর একটি প্যাভিলিয়নকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এক প্রকার গুচ্ছ আকারে। প্রকাশকদের অভিযোগ ছিল প্যাভিলিয়নে ক্রেতা সমাগম থাকলেও স্টলে ছিল না। এবার এই কাঠামোর পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্যাভিলিয়নকে ঘিরে কোনো স্টল বরাদ্দ রাখা হয়নি।

সেই সঙ্গে এবারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের প্রধান সড়ক উন্মুক্ত আকারে রাখা হয়েছে। সড়ক ঘেঁষে স্টল নির্মাণ করা হয়নি। প্যাভিলিয়নগুলোও নির্দিষ্ট জায়গায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এবারে বেশ কয়েকটি প্যাভিলিয়ন উত্তর-পূর্ব কর্নারে রাখা হয়েছে। এতে করে বাম দিক দিয়ে মানুষ হাঁটা শুরু করলেও মেলার সব দিকেই ছড়িয়ে পড়বে। প্যাভিলিয়নগুলো নানা দিকে থাকার কারণে মানুষ সব দিকেই যেতে চাইবে।

Advertisement

জাগো নিউজ : নতুন প্রতিষ্ঠানকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়নি। জায়গা বাড়ানোর পরিকল্পনা...

ফরিদ আহমেদ : জায়গা সংকটের কারণেই নতুন করে স্টল বাড়ানো যাচ্ছে না। আগামীতে অবশ্যই জায়গা বাড়ানোর দাবি রাখব। আর যে দিকেই জায়গা বাড়ানো হবে সে দিকটাই অপ্রচলিত বলে মনে হবে। এবারের কাঠামোটি আগামী দিনের বর্ধিত অংশের সঠিক বিন্যাসের একটি পরিক্ষামূলক নকশা।

জাগো নিউজ : এবারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে পূর্ব দিকে একটি গেট করার কথা ছিল।

ফরিদ আহমেদ : পূর্ব দিকে গেটের জন্য আমরা অনেক দিন থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি। এটি করতে পারলে মেলার রূপ পাল্টে যাবে এবং মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য মেলায় চলাফেরা করতে পারবেন।

এ নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেও বসেছি। কিন্তু বিভিন্ন কারণেই শেষ পর্যন্ত গেট করা সম্ভব হয়নি। মূলত নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আসায় এমন হয়েছে।

এছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব দিকে মাটি ফেলার কাজ চলছে। এবার গেট না করার এটিও একটি কারণ হতে পারে।

এরপরও আমরা চাইব আগামী বছর থেকেই যেন পূর্ব দিকে গেটের ব্যবস্থা রাখা হয়। এই গেটের জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষের যা যা করা দরকার, তারা তাই করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। বাংলা একাডেমি এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ের মাধ্যমে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করি।

জাগো নিউজ : মেলায় কোনো অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ছে?

ফরিদ আহমেদ : মেলা শুরুর সময় ত্রুটিগুলো আসলে চোখে পড়ে না। সেই সময় জনসমাগম কম থাকায় অসুবিধাটা সামনে আসে না। যখনই মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় তখনই নানা সমস্যা সামনে আসে।

মেলার ৫ম দিনেও আমার কাছে অভিযোগ এসেছে কোনো কোনো এলাকায় ইট বিছানো ছিল না। এই ত্রুটিগুলো চোখে পড়ার মতো।

জাগো নিউজ : ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ আছে প্রকাশনাগুলোর বিরুদ্ধেও। তাগিদ থাকলেও মেলার শুরুতে শতভাগ স্টল সাজানো সম্পন্ন করতে পারে না তারা।

ফরিদ আহমেদ : এই অভিযোগ আছে বটে। তবে আমাদের প্রকাশকরা খুবই সচেতন। অল্প কিছু প্রকাশকের কারণে এই অভিযোগ প্রতি বছরই আসে।

অবশ্য এবার একটু কম সময় মিলেছে। মেলা শুরুর আগে কেউ স্টল সাজানো শেষ করতে না পারলে এটিও একটি কারণ। এরপরও ৯৯ ভাগ স্টলই সময় মত কাজ শেষ করেছে।

জাগো নিউজ : সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশই ছিল অমর একুশে বইমেলার উদ্দেশ্য। কয়েক দশক পেরিয়ে আজকের এই ‘পরিণত’ আয়োজন। মেলার আন্তর্জাতিক মান নিয়ে আলোচনা করা যায় কী-না?

ফরিদ আহমেদ : উদ্বোধনের দিন প্রকাশকদের প্রতিনিধি হিসেবে বলেছি আমাদের সাহিত্যমান বাড়াতে দুই বছর অন্তর হলেও একটি আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করা দরকার। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করেই এ কথা বলেছি। এ সময় তিনি (প্রধানমন্ত্রী) সামনেই ছিলেন।

অনেকেই আন্তর্জাতিক মান নিয়ে প্রশ্ন করেন। আসলে সে মানটা কী? অমর একুশে বইমেলা একেবারেই নিজেদের আয়োজনের একটি আঞ্চলিক বইমেলা। ভাষা-শহীদদের স্মরণ করে এই মেলা। আন্তর্জাতিক বিচারের কোনো উপাদান এখানে নেই। বইও আন্তর্জাতিক নয়, আবার বাইরের লেখকরাও এখানে বই প্রকাশ করতে পারছে না। লেখক, প্রকাশক এবং অনুবাদক সবই তো দেশীয় এবং এটি নীতিমালার মধ্যেই আছে।

তবে হ্যাঁ, যে বই এই মেলাতে আসছে, তার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। আন্তর্জাতিকমানের যে বই প্রকাশ হচ্ছে এবং সেখানে যাবার জন্য আমাদের বইয়ের মান বাড়ানোর ব্যাপারে বিশেষ তাগিদ দেয়ার সময় এসেছে বলে মনে করি।

জাগো নিউজ : এই প্রশ্নেই আমরা আজ কোথায় যেতে পেরেছি বলে মনে করছেন?

ফরিদ আহমেদ : প্রকাশনার দিকে থেকে আমরা অনেক ভালো জায়গায় অবস্থান করছি বলে মনে করতেই পারি। লেখকরাও সবচেয়ে ভালোটাই দেয়ার চেষ্টা করেন। এদেশেও আন্তর্জাতিক মানের লেখক আছেন। আবার একেবারে নবীন লেখকও আছেন। সব ধরনের লেখাই আসছে বাজারে। তবে পরিচিতির দিক থেকে আমরা আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছেছি, তা বলা যেতেই পারি।

ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার আয়োজক কমিটির সভাপতির সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেছেন, আমরা চাইলে অমর একুশে বইমেলা আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারে তুলে দিতে পারেন। তিনি বাংলাদেশের মেলা সম্পর্কে অবগত বলেই এমন আশাবাদ দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের পরিচিতি আলোচনার মধ্য দিয়ে। বই দিয়ে সে পরিচিতি এখনও গড়ে ওঠেনি।

জাগো নিউজ : এর কারণ হিসেবে কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেবেন?

ফরিদ আহমেদ : প্রথমত আমাদের ভাষার সীমাবদ্ধতা। বাংলা ভাষায় রচিত বইগুলো যেন বাংলাতেই আটকে আছে। ভাষান্তর না হলে সাহিত্য আন্তর্জাতিক মানের হবে কী করে?

জাগো নিউজ : এর জন্য লেখক না প্রকাশক, কাকে দায়ী করবেন?

ফরিদ আহমেদ : দায়িত্বটা আসলে সবার। অনুবাদ করলেই তো আর আন্তর্জাতিক মানের দাঁড়ায় না। প্রথমত, আন্তর্জাতিক মানের সাহিত্য রচিত হওয়া সময়ের দাবি।

আমার সমাজ-সংস্কৃতির উপকরণগুলো বিশ্বমানের করেই তুলে আনতে হবে। দক্ষিণ আমেরিকার উপন্যাস আমরা তো পড়ছি। অর্থাৎ তাদের সাহিত্য আমাকে তাদের সমাজে সংযুক্ত করছে। আমরা যদি অন্য প্রান্তের মানুষকে সংযুক্ত করতে পারি, তবেই বিশ্বমানের দাঁড়াবে আমাদের সাহিত্য।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গ আসে অনুবাদে। যে মানের অনুবাদ হলে পাঠক সুখ পাবে সেই মানের অনুবাদ জরুরি। এরপর প্রকাশকদের দায়টা আসে। প্রোডাকশনটা উচ্চমানের করতে পারলে সব মিলিয়ে আমাদের সাহিত্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলবে বলে বিশ্বাস করি।

জাগো নিউজ : দায় রাষ্ট্রেরও?

ফরিদ আহমেদ : অবশ্যই। তবে এক্ষত্রে একটি জানালা খোলা আছে বলে আমি মনে করি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ফ্রাঙ্কফুট বইমেলাতে একটি প্যাভিলিয়ন নেয়া আছে। জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির পক্ষ থেকেই প্যাভিলিয়নটি পরিচালনা করা হয়। আমরা বিশ্বমানের সাহিত্য রচনা করতে পারলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার প্লাটফর্মটি তৈরি হয়েছে।

জাগো নিউজ : প্রকাশনার মান নিয়েও নানা প্রশ্ন। বিশেষ করে সম্পাদনায় মনোযোগ নেই প্রকাশনা সংস্থাগুলোর।

ফরিদ আহমেদ : এই অভিযোগ অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থাই আউট সোর্সিংয়ের মধ্য দিয়ে বই প্রকাশ করে আসছে। সম্পাদনা করছেন বাইরের লোক দিয়ে। বই বাঁধাই করছেন বাইরের লোক দিয়ে।

প্রকাশনার দায়িত্ব হচ্ছে পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করা এবং প্রকাশনার ব্যয় বহন করা। কিন্তু অতিরিক্ত হিসেবে করছে বই বিক্রির কাজও। আর এই কারণেই প্রকাশনার মান নিম্নমানের হচ্ছে। বিদেশে বই বিক্রি করেন বিক্রেতারা। প্রকাশকরা কোনোভাবেই বিক্রির সঙ্গে নেই। প্রকাশকের কাজ হচ্ছে সমন্বয় করা। এক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি আছে।

সম্পাদনার কাজে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। প্রকাশকদের মাঝে এই বিষয়টি উপলব্ধিতে নেই। এটি প্রকাশকদের বড় দুর্বলতা। তবে কিছু কিছু প্রকাশনী সংস্থা তাদের নিজেদের সম্পাদনা পরিষদ থেকেই সম্পাদনা করে আসছে এবং সেটা খুবই অল্প সংখ্যক।

এএসএস/এমএমজেড/পিআর