বিনা অপরাধে তিন বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান জাহালম। সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির মামলা থেকে জাহালমকে এক দিনের মধ্যেই অব্যাহতি দেয়া হয়।
Advertisement
কিন্তু যে ব্যক্তির অপরাধে জাহালম কারাগারে যান সে আলোচিত ব্যক্তি আবু সালেকের কোনো খবর নেই। বছর খানেক ধরে লাপাত্তা আবু সালেক। নিজের গ্রামের বাড়ির কারও সঙ্গে নেই কোনো যোগাযোগ। এলাকার লোকজনের চোখেও পড়েননি সালেক। কোথায় আছেন সালেক কেউ জানেন না।
আলোচিত আবু সালেক ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের সিঙ্গিয়া গ্রামের আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে। চার ছেলে মেয়ের মধ্যে তৃতীয় সন্তান আবু সালেক।
বলা চলে আঙুল ফুলে কলাগাছ হন আবু সালেক। দুই বছর আগে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন তিনি। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বছর খানেক সংসারের পর বিচ্ছেদ হয়ে যায়। দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে সালেকের মা-বাবার বনিবনা না হওয়ায় গ্রামের বাড়িতে আসেন না সালেক।
Advertisement
তবে গ্রামে একটি আলিশান বাড়ি রয়েছে তার। ওই বাড়িতে বাবা-মা বোন থাকলেও সারাক্ষণ বাড়ির ভেতর থেকে তালাবদ্ধ থাকে। বাইরের কেউ যায় না ওই বাড়িতে।
সালেকের বাবা আব্দুল কুদ্দুস বলেন, এসএসসি পরীক্ষার পর আমার বকুনি খেয়ে ঢাকায় পাড়ি জমায় আবু সালেক। সংসারে একমাত্র ছেলে হওয়ায় কারও কথা শুনত না। মানত না পরিবারের শাসন। বেপরোয়া সালেক ঢাকায় থাকলেও পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। ঢাকায় ভোটার আইডি কার্ড (এনআইডি) তৈরির সঙ্গে সালেক যুক্ত ছিল বলে আমরা শুনেছি।
সালেকের গ্রামের আনসারুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেন ও আব্দুর রশিদ বলেন, হঠাৎ বড় লোক হয়ে যান আবু সালেক। বাড়িঘর ছিল কাঁচা মাটির। কিন্তু হঠাৎ করে আলিশান বাড়ি বানান। বাড়ির সাজসজ্জা, গেট আর বহু রঙের বাড়ির ঝলকে চোখ জুড়ায়। গ্রামের বাড়িতে সম্পদ না বানালেও বোনের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় টেলিভিশনের শো-রুম দেন আবু সালেক। সেখানে কিনেছেন বেশ কিছু জমি।
সালেকের বাবা আব্দুল কুদ্দুস ছেলের অপকর্মের শাস্তি দাবি করে বলেছেন, তার আত্মসাৎ করা টাকায় আমরা কখনও হাত দেইনি। ওসব টাকা দিয়ে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় সম্পদ কিনেছে সালেক। তার টাকায় আমাদের এই বাড়ি করিনি। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া আবাদি ২০ বিঘা জমির আয় দিয়ে আমি এই বাড়ি বানিয়েছি। আমার আয় দিয়ে আমি সংসার চালাই। এখানে তার কিছুই নেই।
Advertisement
বালিয়া ইউপির চেয়ারম্যান নুর-এ আলম সিদ্দিকী মুক্তি বলেন, আবু সালেক একজন প্রতারক। তার বিরুদ্ধে এলাকাতেও ছোট বড় অনেক অপরাধের নালিশ আছে। সালেকের বিরুদ্ধে জালিয়াতি মামলার সত্যতা আছে। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই আমরা।
সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলায় নিরপরাধ জাহালম তিন বছর জেল খাটে। তথ্য অনুযায়ী, আবু সালেকের (মূল অপরাধী) বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খেটেছেন জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক। তিনি টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানার ধুবড়িয়া এলাকার ইউসুফ আলীর ছেলে।
আবু সালেকের ১০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ভুয়া ঠিকানাগুলোর একটিতেও জাহালমের গ্রামের বাড়ির কথা নেই। রয়েছে পাশের আরেকটি গ্রামের ভুয়া ঠিকানা। কিন্তু সেটাই কাল হয়ে দাঁড়াল জাহালমের জীবনে।
নির্ধারিত দিনে দুই ভাই হাজির হন দুদকের ঢাকার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। জাহালম বুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’
২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ঘোড়াশালের মিল থেকে জাহালমকে গ্রেফতার করা হয়। জাহালম তখন জানতে পারেন, তার নামে দুদক ৩৩টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে, তিনি বড়মাপের অপরাধী।
পরে আদালতে শুনানি শেষে সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির অভিযোগে দুদকের করা সব মামলা থেকে নিরীহ জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে মুক্তির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
রবিউল এহসান রিপন/এএম/জেআইএম