সিন্ডিকেট ও নানা অনিয়মের অভিযোগে স্থগিত রয়েছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। গত সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ থাকা বাংলাদেশের অন্যতম বড় এই শ্রমবাজার ফের কবে চালু হবে, সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি এখনও। তবে বাজারটি নিয়ন্ত্রণে নিতে আরেকটি সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম যুক্ত করে ফেসবুকে পেজ খুলে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যেতে ইচ্ছুকদের আকর্ষণ করা হচ্ছে।
Advertisement
প্রতারণা যেন পিছু ছাড়ছে না বিদেশে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের। বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। এসব কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, উইচ্যাটসহ বিভিন্ন মাধ্যম।
সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে প্রতারণা কিছুটা কমলেও ফের নড়েচড়ে বসেছে কথিত দালালরা। সহজ-সরল বেকার যুবকরা বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম দেখে বিশ্বাস করে প্রতারণার ফাঁদে পড়তে পারেন- এমনই মনোভাব প্রকাশ করেছেন মালয়েশিয়া প্রবাসীরা।
আরও পড়ুন> মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে কেউ খেলছে, সাবধান করলো দূতাবাস
Advertisement
দালালদের কারণে একদিকে ক্ষুণ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের ভাবমূর্তি অন্যদিকে সহায়-সম্বল বিক্রি করে পথে বসছে হাজার হাজার যুবক। ফেসবুকের মাধ্যমে বিদেশে যেতে ইচ্ছুকদের ব্যাপারে চটকদার বিজ্ঞাপন ও সর্বনিম্ন মূল্যে বিদেশে যাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাটাস আপডেট করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আপনাদের মোবাইল নম্বরটা দেন, আমরা যোগাযোগ করে নেব। ওই নম্বরে যোগাযোগ করে বলা হচ্ছে, মেডিকেল করে আসেন ভিসা পাওয়া যাবে। মেডিকেল করার পর নেয়া হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য মেডিকেল সেন্টার অনুমোদন নিতে তৎপরতাও শুরু করেছে ওই মহলটি। গত রোববার ফোমেমা নামে মালয়েশিয়ার একটি বেসরকারি মেডিকেল চেকাপ সংগঠনের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে। প্রতিনিধি দলের প্রধান ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ী আবু হানিফ মো. আবুল কাশেম।
বাংলাদেশ থেকে যেসব কর্মী মালয়েশিয়ায় যাবে, তাদের মেডিকেল চেকাপের জন্য মেডিকেল সেন্টার স্থাপন করে মূলত শ্রমবাজারটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাচ্ছেন বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার এই ব্যবসায়ী মহল। যেটি আগে একক নিয়ন্ত্রণে ছিল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আরেক মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ী আমিন নূরের।
আরও পড়ুন> সিন্ডিকেটমুক্ত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, আলোচনার পর নতুন সিদ্ধান্ত
Advertisement
সফররত মালয়েশিয়ার বেসরকারি মেডিকেল চেকাপ সংগঠন ফোমেমার প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের বেশকিছু মেডিকেল সেন্টার বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিদর্শন করেন। গতকাল সোমবার প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে তারা সাক্ষাতের চেষ্টা করেন। কিন্তু মন্ত্রীর সিডিউল না পাওয়ায় তারা দেখা করতে পারেননি। মঙ্গলবার দুপুরে তাদের সাক্ষাতের কথা রয়েছে।
এদিকে, গতকাল সোমবার সকালে রাজধানীর ইস্কাটন বায়রা ভবনে সংগঠনটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মালয়েশিয়া থেকে সফরে আসা ফোমেমার কর্মকর্তারা। যেখানে মেডিকেল সেন্টারের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান বায়রা মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জনশক্তি রফতানিতে ‘জি-টু-জি প্লাস’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তির আগে থেকে আমিন নূরের সিনারফ্ল্যাক্স ও বেস্টিনেট এবং হানিফের রিয়েল টাইম শ্রমবাজারটি নিয়ন্ত্রণে নিতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করে। ওই দু’জনের হয়ে বাংলাদেশের জনশক্তি ব্যবসায়ীরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত আমিন নূরের সিনারফ্ল্যাক্স অনলাইন সিস্টেম ‘এসপিপিএ’ ও বেস্টিনেট কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার দায়িত্ব পায়। বাংলাদেশের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকের সমন্বয়ে প্রায় দুই বছর একচেটিয়া ব্যবসা করেন আমিন নূর।
শ্রমিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ও সিন্ডিকেটের অভিযোগে মালয়েশিয়া সরকার অনলাইন সিস্টেম ‘এসপিপিএ’ বাতিল ঘোষণা করে। নতুন সিস্টেম চালু না হওয়া পর্যন্ত ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে শ্রমিক নেয়া গত সেপ্টেম্বর থেকে স্থগিত রেখেছে। মাঝখানে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মধ্যে দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও কবে নাগাদ বাজারটি চালু হবে তা স্পষ্ট করেনি মালয়েশিয়া। কিন্তু স্থগিত এই বাজার দখলে নিতে জনশক্তি ব্যবসায়ী ও মালয়েশিয়ার একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে পড়েন।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা সফরে আসা সাত সদস্যের প্রতিনিধি দলে ফোমেমার কর্তৃপক্ষসহ রয়েছেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী আবু হানিফও। তারা বেস্টিনেটের ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রালাইজড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা এফডব্লিউসিএমএস-এর পরিবর্তে ফোমেমা প্রবর্তন করতে চাচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে ফোমেমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঢাকায় অবস্থানকালে তিনদিনে ৪৫টি মেডিকেল সেন্টার পরিদর্শন করার কথা। মূলত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার দায়িত্ব ফোমেমার কাছে ন্যস্ত করে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারটি নিয়ন্ত্রণে আরেকটি সিন্ডিকেট তৈরির চেষ্টা হচ্ছে বলে আশঙ্কা এ খাত সংশ্লিষ্টদের।
সূত্র জানায়, জি-টু-জি প্লাস চুক্তির আলোকে বিগত দিনে একচেটিয়া ব্যবসা করেছেন ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক। যার মূলে ছিলেন আমিন নূর। এবার আমিন নূরের পরিবর্তে আবু হানিফকে সামনে রেখে আরেকটি সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যারা এই শ্রমবাজারে একচেটিয়া ব্যবসা করতে চাচ্ছেন।
আরও পড়ুন> মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা
এ বিষয়ে বায়রা মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, ফোমেমার একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। মেডিকেল সেন্টার স্থাপন সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে তারা বেসরকারি প্রতিনিধি দল। মেডিকেল সেন্টারের অনুমোদনের বিষয়টি সরকারি পর্যায়ে হয়ে থাকে। সুতরাং তাদের সফর মানেই যে মেডিকেল সেন্টার অনুমোদন হয়ে গেল বা সিন্ডিকেট হয়ে যাচ্ছে, এমনটি নয়।
এদিকে মালয়েশিয়ার স্থগিত শ্রমবাজার উন্মুক্ত না হলেও মেডিকেল সেন্টার স্থাপন বা অনুমোদন নিয়ে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী মহলের দৌড়ঝাঁপ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ম্যানপাওয়ার ব্যবসায়ীরা। তাদের আশঙ্কা, জিটুজি প্লাস পদ্ধতি শুরুর পর যেভাবে মাত্র ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে নিয়ে আমিন নূর সিন্ডিকেট করে এক চেটিয়া ব্যবসা করেছেন, এবার আরেক ব্যবসায়ী হানিফের নেতৃত্বেও আরেকটি সিন্ডিকেট তৈরির অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। জনশক্তি ব্যবসায়ী আব্দুল আলীম (এসএ ট্রেডার্স) এই প্রতিবেদককে বলেন, সফররত টিমটি মালয়েশিয়া সরকারের কেউ নন।
তারা এখানে (ঢাকা) এসেছে মেডিকেল সেন্টারের অ্যাপ্রুভাল নিতে। তারা প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন বলে শুনেছি। কিন্তু মন্ত্রী এই টিমকে সাক্ষাৎ দেবেন কি দেবেন না, সেটা তার বিষয়। তবে মালয়েশিয়ার বেসরকারি মেডিকেল চেকাপ সেন্টারগুলোর সংগঠন ফোমেমার পক্ষ থেকে সফরতদের সামগ্রিক কার্যক্রম তুলে ধরে প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন বলে জানান আব্দুল আলীম।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম শাখার প্রথম সচিব (শ্রম) মো. হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডল বলেন, মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে কাজ, বেতন, আবাসিক, চিকিৎসা ইত্যাদি নিশ্চিতের কাজ করছে হাইকমিশন। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা আবশ্যক। অপতত তৎপরতার কারণে ভালো উদ্যোগগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পাশাপাশি বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বিরুপতা তৈরি হচ্ছে। তাদের কারণে বৈধরাও নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। দূতাবাস সব অপতৎপরতা রুখে দিতে কাজ করছে।
‘বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম ব্যবহার করে ফেসবুকে প্রচার-সংক্রান্ত বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে’- বলেও জানান তিনি।
এমআরএম/আরআইপি