১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি আরাকান মগ জলদস্যুদের তাড়িয়ে চট্টগ্রাম দখলে নেন মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ। প্রতিষ্ঠা করেন এ অঞ্চলের প্রথম মুঘল সদর নৌ-বন্দর। কালের বিবর্তনে যা আজকের সদরঘাট। কর্ণফুলী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, কর্ণফুলীতেও জল গড়িয়েছে অনেক কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তবে সবাই বলছেন, এবার কিছু হবে।
Advertisement
আরও পড়ুন >> কর্ণফুলীতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু
চার শতাব্দী আগে যেখান থেকে নতুন চট্টগ্রামের শুরু আজ সেই মুঘল সদর নৌ-বন্দরের স্মৃতিময় স্থান থেকে শুরু হয়েছে কর্ণফুলী বাঁচানোর অভিযান।
মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ এ স্থানেই প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম মুঘল সদর নৌ-বন্দর
Advertisement
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পতেঙ্গা ভূমি সহকারী কমিশনার তাহমিলুর রহমান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাক্তাই থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত কর্ণফুলীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান তিন জোনে ভাগ করা হয়েছে। মোট দুই হাজার ১৮৭টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। প্রথম ধাপে আজ সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত ২০০ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। এর পুরোটা উচ্ছেদ হলে প্রায় ১০ একর জায়গা উদ্ধার হবে।’
‘প্রতিদিনই উদ্ধারকাজ চলবে। যতক্ষণ না শেষ হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে অপর দুটি জোনে উচ্ছেদ অভিযান চলবে।’
অভিযানের বিষয়ে তিনি জানান, কর্ণফুলী বাঁচানোর অভিযানে অংশ নিচ্ছে চট্টগ্রামের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। অভিযানে লোকবল ও যন্ত্রাংশ দিয়ে সহায়তা করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। তারা এ অভিযানে একটি বুলডোজার, দুটি ট্রাক ও একটি এক্সকাভেটর (মাটি খননের যন্ত্র) দিয়ে সহায়তা করছে। এছাড়া অভিযানে অংশ নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ, বিটিসিএল, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড, চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
‘যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে কর্ণফুলী বাঁচানোর অভিযানে অংশ নিচ্ছেন পুলিশের দেড়শ সদস্য, র্যাব-৭ এর ১০০ সদস্য এবং ফায়ার সার্ভিসের ২০ সদস্যের একটি দল। সহায়তা করছেন নৌ-পুলিশের সদস্যরাও’- বলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান।
Advertisement
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে কর্ণফুলী নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে নদীর সীমানা নির্ধারণ, দখল, ভরাট এবং নদীতে যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস এ পিস ফর বাংলাদেশ’র পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জনস্বার্থে এ রিট দাখিল করেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ১৮ জুলাই কর্ণফুলী নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও ভূমি জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
আরও পড়ুন >> মানুষকে ক্ষমতা দেখাও?
আদালতের নির্দেশনা প্রতিপালনের লক্ষ্যে গঠিত ১৬ সদস্যের কমিটি ২০১৬ সালের ১৮ জুন আরএস ও বিএস রেকর্ড অনুযায়ী কর্ণফুলী নদীর বর্তমান অবস্থান ও দখলদারদের চিহ্নিত করে একটি তালিকা তৈরি করেন। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট কর্ণফুলী নদীর দুই তীর দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা সরাতে ৯০ দিন সময় দিয়ে আদেশ দেন।
আদালতের আদেশে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে দুই হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়। গত তিন বছরে স্থাপনা আরও বেড়েছে। এর মধ্যে ছয়টি সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ কন্টেইনার ডিপোও স্থাপন করে কর্ণফুলী দখল করা হয়েছে।
অবৈধ দখলদারদের তালিকায় জনপ্রতিনিধি, শিল্পপতি ও বড় ব্যবসায়ীদের নামও রয়েছে।
জানা গেছে, অর্থ সংকটসহ নানা জটিলতায় এতদিন উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বরাদ্দের পর এ উচ্ছেদ অভিযানে নামে জেলা প্রশাসন।
আশার দিক হলো, শুধু জেলা প্রশাসন নয়। অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘আমার কাছে অনেক কল এসেছে। রিকোয়েস্টও এসেছে। আমি মনে করি, এখানে রিকোয়েস্ট রাখার কোনো সুযোগ নেই। দীর্ঘসময় আমরা দিয়েছি। আর কিছু করার নেই। আমরা সবকিছু বিবেচনা করেই কাজ করছি।’
নদীপাড় দখল করে রাখা প্রভাবশালীদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কোনো প্রভাবশালী নাই। প্রভাবশালী বলতে আমি কিছু বুঝি না। সরকারের চেয়ে প্রভাবশালী কে? মহামান্য আদালতের রায় আমাদের পক্ষে আছে।’
এদিকে, আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেক পরে হলেও কাজ শুরু হয়েছে- এটাই প্রাপ্তি। তবে জেলা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ থাকবে, তারা যেন এ উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গিয়ে কোনো রাজনৈতিক বা পেশিশক্তির কাছে হার না মানেন। দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকে সব অবৈধ স্থাপনাই যাতে উচ্ছেদ হয়।’
তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘কর্ণফুলী নদী রক্ষায় দুঃসাহসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরী। বিশেষ করে পতেঙ্গা থেকে সল্টগোলা হয়ে বারিক বিল্ডিং মোড়, মাঝিরঘাট, সদরঘাট, ইয়াকুব নগর, ফিরিঙ্গি বাজার, চাকতাই, লালদিয়ার চর, কালুরঘাট পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ধ্বংস করা হয় চার হাজার অবৈধ স্থাপনা। উদ্ধার করা হয় কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তীসহ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ১২৫ একর জমি।’
‘চট্টগ্রাম বন্দরের ১২৪ বছরের ইতিহাসে মুনীর চৌধুরীর সময়ের মতো উচ্ছেদ অভিযান আর কখনও হয়নি’- যোগ করেন মনজিল মোরসেদ।
তিনি বলেন, ‘২০০৬ সালের ওই অভিযানের পর সরকার পরিবর্তন হয়। ফলে উদ্ধার হওয়া জমি ফের চলে যায় প্রভাবশালীদের দখলে। খুব করে চাই, এবার সেটি যেন আর না হোক।’
এ বিষয়ে পতেঙ্গা ভূমি সহকারী কমিশনার তাহমিলুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আদালতের নির্দেশ অনুসারে আরএস দাগ ধরে গত তিনদিনে নদীর সীমানা নির্ধারণ হয়েছে। আজ থেকে উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে এবং উচ্ছেদের পাশাপাশি উদ্ধার হওয়া জমি পিলার দিয়ে চিহ্নিত করে দেয়া হচ্ছে। যাতে আর কেউ এসে তা দখলে নিতে না পারে।’
দুপুর ১২টার দিকে উচ্ছেদ অভিযান দেখতে আসেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন দিক থেকে হুমকি-ধমকি পাচ্ছি। কিন্তু এসব কোনো কাজে আসবে না। উচ্ছেদ অভিযান চলবে।’
আবু আজাদ/এমএআর/এমএস