জাতীয়

‘দুদকের কমিশনার বলছি, বাঁচতে চাইলে দেখা করুন’

‘হ্যালো, আমি দুদকের কমিশনার বলছি। আপনার বিরুদ্ধে কিছু ফাইল জমা পড়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে মামলা রুজুর পর সেটার তদন্ত হচ্ছে। বাঁচতে চাইলে দেখা করুন।’

Advertisement

এভাবেই সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মোবাইলফোনে দুদকের কমিশনার, পরিচালক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে তটস্থ রাখছে একটি অপরাধীচক্র।

দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে প্রায় ৪০ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। আর এ টাকা লেনদেন হয়েছে কখনো বিকাশে কখনো নগদে।

গত ২৭ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কার্যালয় থেকে র‌্যাব ডিজি বরাবর পত্রযোগে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিচয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফোন করে দুর্নীতির মামলা রুজু ও তদন্ত চলছে- মর্মে ভয় দেখিয়ে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ করা হয়। হয়রানি বন্ধ ও তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দুদক ওই পত্রযোগে অনুরোধ করে র‌্যাবকে। র‌্যাব সদর দফতর বিষয়টি অনুসন্ধানের জন্য র‌্যাব-২-কে নির্দেশনা দেয়।

Advertisement

এরপর অনুসন্ধানের মাধ্যমে রাজধানীর হাজারীবাগের বউবাজার এলাকা হতে শুক্রবার রাতে আনিছুর রহমান ওরফে বাবুল (৩৬) ও বিকাশ এজেন্ট মো. ইয়াসিন তালুকদারকে (২৩) আটক করে র‌্যাব-২। এরপর তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। আটক বাবুলের কাছ থেকে ৩টি মোবাইলফোন ও ভুয়া রেজিস্ট্রিশনকৃত ১৪টি সিম ও ইয়াসিনের কাছ থেকে ১২টি সিম ও ১৮টি মোবাইলফোন জব্দ করা হয়।

শনিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-২ এর কোম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী বলেন, চক্রটি সক্রিয় ২০১৪ সাল থেকে। তবে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরুর পর তাদের প্রতারণার কৌশল বদলে যায়। দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের পর প্রতারকচক্র নতুন কৌশলে নামে। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টার্গেট করে। টার্গেটকৃতদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক, ভূমি অফিস, স্বাস্থ্য অধিদফতর, পুলিশ, বিভিন্ন এনজিওসহ উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী।

আটক আনিছুর রহমান বাবুল জিজ্ঞাসাবাদে জানান, মাদারীপুরের রাজৈর থানা এলাকার এক ব্যক্তি এই চক্রের মূলহোতা। তার হাতধরেই এই প্রতারণাচক্রে তার হাতেখড়ি।

র‌্যাব-২ এর কোম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী বলেন, প্রথমে চক্রটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিগ্রস্তদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়। এরপর সরকারি টেলিফোন ইনডেক্স থেকে মোবাইল কিংবা টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দেয়। বলে, ‘হ্যালো, আমি দুদকের পরিচালক বলছি, আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হয়েছে। সেটি আমি তদন্ত করছি। তদন্তের স্বার্থে আপনার সাক্ষাৎ প্রয়োজন।’

Advertisement

এরপর অনেকে তাদের ব্যক্তিগত নম্বর চেয়ে নিয়ে যোগাযোগ করে বিকাশের মাধ্যমে টাকা দিয়ে বিষয়টি মিটিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেন। আবার অনেকে দেখা করে টাকা দেন। তবে দুর্নীতিগ্রস্ত নন এমন কর্মকর্তারা দুদককে বিষয়টি অভিযোগ করেন। এরপর বিষয়টি নজরে আসে।

মহিউদ্দিন ফারুকী বলেন, ২০১৪ সালে থেকে এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দফতরের পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ৪০ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। আটক দুজনের বিকাশ অ্যাকাউন্টেও এর তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। আনিছুরের ব্যক্তিগত বিকাশ নম্বরেই গত ছয় মাসে জমা হয়েছে ১২ লাখ টাকা। আর ইয়াসিনের বিকাশ নম্বরে ৫০ হাজার টাকা পাওয়া গেলেও লেনদেন হয়েছে নয় লাখেরও বেশি।

জিজ্ঞাসাবাদে ইয়াসিন তালুকদার জানান, এইচএসসি পাস করার পর ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ না করেই ব্যবসায় নামেন। ফ্লেক্সিলোড ও বিকাশ এজেন্টের ব্যবসা তার। তিনি গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক দিনমজুরের এনআইডি কার্ডের ও হতের ফিঙ্গারপ্রিন্ট একাধিকবার নিয়ে সিম রেজিস্ট্রেশন করে বিকাশ অ্যাকাউন্ট খোলেন। পরে সেটি প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে আসছিলেন।

এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাব-২ এর এই কর্মকর্তা বলেন, যারা দুর্নীতির মামলার তদন্তের কথা শুনে বিকাশে টাকা দিয়েছেন, যোগাযোগ করেছেন তাদের ব্যাপারেও আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। এ ঘটনায় মামলা হবে। যেই তদন্ত করুক না কেন দুর্নীতির কথা শুনেই যারা টাকা দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি প্রতারকচক্রের মোবাইলফোনে যোগাযোগকারীদের তালিকা প্রস্তুত করা হবে।

জেইউ/বিএ/আরআইপি