একুশে বইমেলা

বইমেলা ঘিরে বাড়ছে লেখক-প্রকাশক দূরত্ব

শুক্রবার শুরু হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা ২০১৯। মেলাকে ঘিরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন লেখক ও প্রকাশকগণ। সাহিত্যের বিশাল এই আয়োজনে লেখকদের অভিযোগের অন্ত নেই। হয়তো সমাধানের পথও কারও জানা নেই। সেসব অভিযোগ নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার-

Advertisement

অমর একুশে বইমেলার আয়োজন থেকে শুরু করে সব কাজেই রয়েছে শুভ চিন্তার অফুরন্ত সমাহার। কিন্তু একে ঘিরে আমাদের সব উদ্দেশ্য ইতিবাচক হলেও কিছু বিষয় অত্যন্ত নেতিবাচক ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ। প্রথমত পুস্তক প্রকাশকদের কথাই বলা যাক। তারা বইমেলার মৌলিক ধারণার প্রতি আস্থা অর্জনে কোন কাজ করেন না বললেই চলে।

অধিকাংশ প্রকাশক শুধু এ মেলাকে নিজেদের মুনাফা অর্জনের একটি মাধ্যম বলেই মনে করেন। সঙ্গে সঙ্গে বঞ্চিত করেন লেখকদেরও। যার প্রমাণ হিসেবে প্রকাশকদের সর্বদা প্রকাশনা খাতকে অলাভজনক খাত হিসেবেই উপস্থাপন করতে দেখা যায়। কিন্তু সে খাতে তারা টিকে থাকেন যুগের পর যুগ। আর প্রত্যেকটি বই পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং সে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করে বই লেখা, উৎপাদন ও বিপণনকে সফল করতে সব পদক্ষেপ থাকে প্রকাশকদের হাতে। তারা ইচ্ছে করলে কোন নিম্নমানের বইকে পাঠকপ্রিয়তা দিতে পারেন। আবার ইচ্ছে করলে কোন মানসম্পন্ন বইকেও পারেন মানহীনতার কাতারে ফেলতে।

> আরও পড়ুন- ঢাকায় আবার আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজনের উদ্যোগ

Advertisement

কোন কোন প্রকাশক সে সক্ষমতাকে পুঁজি করে নতুন লেখকদের কাছ থেকে লুফে নেন নিজের মুনাফাসহ বই উৎপাদনের সম্পূর্ণ খরচ। আর টাকার বান্ডেল নিয়ে ঘুরে বেড়ান প্রসিদ্ধ লেখকদের দ্বারে দ্বারে। এরপর বই বিক্রি না হলেও প্রকাশকদের কোন ক্ষতি নেই। যা বিক্রি হয়, তা পরে প্রকাশকের অতিরিক্ত বোনাসের তালিকায় যুক্ত হয়। লেখক থাকেন আগের মতোই শূন্য হাতে খাতা আর কলম নিয়ে। শেষ পর্যন্ত কয়েকটি ফটোসেশন আর অটোগ্রাফ দিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় লেখককে। এতে বোঝা যায়, লেখকের লেখা আর বইয়ের মূল্যায়ন করার কোন সঠিক মানদণ্ড আমাদের কাছে নেই। লেখা আর বই মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি ও অন্ধত্বের আশ্রয় নেয়া হয়।

এবার লেখকদের কথাই বলা যাক। অধিকাংশ লেখক রসাত্মক চমক, দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ ও মৌলিকতা বিবর্জিত বই প্রকাশ করে সাময়িকভাবে পাঠকদের মনোরঞ্জন করতে ব্যস্ত থাকেন। বিশেষ করে শিশুসাহিত্যিকগণ সারা বছরই লিখে বেড়ান ভূত, এলিয়েন, মিথ্যা ও কাল্পনিক দৈত্য দানবের গল্প। যার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্তই রয়েছে মিথ্যার ছড়াছড়ি। গভীরভাবে অনুধাবন করলে দেখা যায়, যা একদম হাস্যকর। ছোটদের বইয়ের ক্ষেত্রেই এমনটি বেশি ঘটে। এতে চরমভাবে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে ছোটদের মঝে।

অদূর ভবিষ্যতে বাস্তব জীবনের দিকনির্দেশনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে তাদের মাঝে জন্ম নেয় চরম অনীহা। এরপর বইমেলায় এসেই তারা খুঁজতে থাকে দৈত্য-দানব আর ভূত-পেত্নির গল্পের বই। অভিবাবকরাও এসব লেখকদের আদর্শ হিসেবে গণ্য করেন। অথচ এ লেখকগণই শিশুদের আদর্শ একটি জীবন বিনির্মাণের ক্ষেত্রে বিষফোঁড়া ও হুমকিস্বরূপ। যে কারণে বাস্তবতার প্রতি শিশুরা থাকে একদম বেখেয়াল। তাই বাস্তব জীবনের সূচনায় তাদের জীবন বিনির্মাণের ক্ষেত্রে পড়তে হয় বিপাকে।

> আরও পড়ুন- বইমেলা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছে

Advertisement

দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাছেও এসব মিথ্যা ভূত-পেত্নি সর্বস্ব লেখকদের মূল্যায়ন অনেক। প্রত্যেক বছরই স্বর্ণপদক আর মোটা অঙ্কের পুরস্কার ঝুলিয়ে দেয়া হয় তাদের গলায়। কিন্তু তারা যে বিষয়বস্তুকে নিয়ে শিশুদের আনন্দ দেন, তা সম্পূর্ণ সাময়িক আনন্দ দান মাত্র। এ ধরনের বিষয়গুলো সবসময় আমাদের দৃষ্টির অগোচরেই পড়ে থাকে।

যে মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমরা আজ বিশ্বব্যাপি সমাদৃত। ভাষার মাসকে ঘিরে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য যে বইমেলার আয়োজন করা হয়, সে মেলার বিভিন্ন সেমিনারে কথায় কথায় বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণ না করলে যেন অনেকের খাবারই হজম হয় না। এভাবে বলতে পেরে তারা নিজেদের নিয়ে খুবই গর্ববোধ করেন। অথচ এতে নতুন প্রজন্ম নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি অনুপ্রাণিত হওয়ার বিপরীতে বিমুখই হয় বেশি।

তাই আমাদের প্রত্যেকের জায়গা থেকে প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। লেখক-প্রকাশক দূরত্ব ঘোচাতে হবে। পাণ্ডুলিপি বাছাই এবং প্রচার-প্রচারণায় সবাইকে ইতিবাচক হতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

এসইউ/জেআইএম