টানা এক বছর দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করে তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল ইসলামকে ছাড়িয়ে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী।
Advertisement
গত বছর জানুয়ারির শেষদিকে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান নেন প্রায় একশটির মতো মামলার আসামি রিজভী। এরপর থেকে কার্যালয়েই কেটে গেল তার একটি বছর। রিজভীর এ অবস্থানে দলের মধ্যে রয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। কেউ বলছেন, এর মাধ্যমে তিনি ‘আবাসিক’ নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন; আবার কেউ বলেছেন, রিজভী আহমেদ নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যা তার পূর্বসূরি তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও করতে পারেননি।
সূত্র জানায়, পরিবার-পরিজন ছেড়ে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তৃতীয় তলার যে কক্ষে তিনি রাত্রিযাপন করেন সে জায়গা কারাগারে থাকার জায়গার চেয়েও সংকুচিত। দলীয় কার্যালয়ে থেকেই রিজভী নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করেন দলের পক্ষ থেকে। এছাড়া দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বেশ কয়েকটি ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিলও করেছেন তিনি। পরিবার ও দলের নেতাকর্মীরা নিয়মিতই তার জন্য খাবার নিয়ে আসেন নয়াপল্টন কার্যালয়ে। কার্যালয়ের কর্মচারীরা ছাড়াও দলের সহ-দফতর সম্পাদক মুহাম্মদ মুনির হোসেন, বেলাল আহমেদ, তাইফুল ইসলাম টিপু, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আমিনুল ইসলাম এবং মৎসজীবী দলের নেতা আরিফুর রহমান তুষার তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তার স্বেচ্ছায় এ অবরুদ্ধ সময়ে স্ত্রী আঞ্জুমান আরা আইভীসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের খুব মিস করেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন রিজভী।
জানতে চাইলে ‘স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ’ সময়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘খুব ভোরেই ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করি। পরে তিনতলার সংবাদ সম্মেলন কক্ষে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা করি। রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত দিনের সময় পার হয় দলীয় কর্মকাণ্ডে। এছাড়া দলীয় কার্যালয়ে অধিকাংশ সময় কাটে উপন্যাস আর রাজনৈতিক বই পড়ে।’
Advertisement
রিজভী বলেন, ‘আমি কার্যালয়ে অবস্থান করছি দেশনেত্রীর মুক্তির আন্দোলন হিসেবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারামুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত কার্যালয়েই থাকতে চাই।’
রিজভীর এ অবস্থান সম্পর্কে দলের নির্বাহী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদটি তারেক রহমানের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে এ পদে দায়িত্ব দেয়া হয়। মির্জা ফখরুল ইসলাম মহাসচিব হওয়ার পর রিজভী আহমেদ সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পান। এ দায়িত্ব পেয়ে রিজভী আহমেদ পরিবার-পরিজন ছেড়ে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন এতে তার পূর্বসূরি দু’জনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন। নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা তারেক রহমান-মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও করতে পারেননি। তিনি জাতীয়তাবাদী শক্তির অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। দলে সঠিক মূল্যায়ন হলে রিজভী আহমেদ পরবর্তীতে মহাসচিব বা স্থায়ী কমিটিতে যাবেন।’
দলের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক এক সহ-দফতর সম্পাদক বলেন, ‘রিজভী আহমেদ দলের একজন ত্যাগী নেতা, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উনি হয়তো ইমশনালি অবস্থান করছেন। কিন্তু দলের অনেকেই উনার রাজনৈতিক ধারণা সমর্থন করেন না। উনি প্রতিদিন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। প্রতিদিন কথা বলতে হবে কেন? উনাকে আবাসিক নেতা হিসেবে ঠাট্টা করা হচ্ছে। প্রতিদিন স্থায়ী কমিটির নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রাম থাকে সেখানে তো তারা কথা বলেন। উনি পার্টি অফিসে বসে বসে বক্তব্য দেয়ার কারণে অনেক সময় স্থায়ী কমিটি বা মহাসচিবের বক্তব্য গণমাধ্যমে গুরুত্ব পায় না। এছাড়া উনাকে পরিবার-পরিজন ছেড়ে দলীয় কার্যালয়ে থাকতে হবে কেন? উনি যে গ্রেফতারের আশঙ্কা করেন- এটা কতটা ঠিক? দলের তো এর চেয়েও খারাপ সময় গেছে, উনি জেলে গেছেন তারপর পর্যায়ক্রমে শামসুজ্জামান দুদু, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ড. আসাদুজ্জামান রিপন মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তো এক্সিকিউটিভ পোস্ট, উনি দফতরে পড়ে আছেন কেন? দলে ‘এক নেতা, একপদের’ যে নীতি সেটা তো উনি মানছেন না।’
‘রিজভী আহমেদ গ্রেফতার হলে শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি আছেন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সসহ অনেকে আছেন যারা দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা রাখেন।’
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, রিজভী আহমেদ পরিবার ছাড়া কষ্টের মধ্যে জীবন-যাপন করছেন, এটা দলের অনেকে সমর্থন করেন না। কারণ উনার এ অবস্থানের মাধ্যমে স্ত্রীর হক নষ্ট করছেন। বলা যায়, রিজভী আহমেদের চেয়ে তার স্ত্রী আরও বেশি ত্যাগ স্বীকার করছেন। রিজভী আহমেদ এমন করে হয়তো বড় নেতা হবেন, মন্ত্রী হবেন কিন্তু তার স্ত্রী তো এসব এনজয় করবেন না। তাকে কেন এত কঠিন ত্যাগ স্বীকার করতে হচ্ছে?’
‘আমরা যারা রাজনীতি করি বা অন্য যারা পেশাজীবী রয়েছেন তারা তাদের কাজ শেষে স্বাভাবিকভাবে পরিবারকে সময় দেন। কিন্তু উনি দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। এটা দল সমর্থন করে না। কারণ দল এতটা অমানবিক নয়। আর যদি কেউ সমর্থন করেন তাহলে আমি বিশ্বাস করি তারা অসুস্থ মস্তিষ্কের।’
অবশ্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ বলেন, ‘রিজভী আহমেদ বাধ্য হয়েই দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য, দলের স্বার্থে তিনি যে কষ্ট করছেন নেতাকর্মীর তার প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তার এ অবস্থানের বর্ষপূর্তিতে অভিনন্দন জানাই। তার এ কষ্টের বিনিময়ে নিশ্চয় একদিন গণতন্ত্র মুক্তি পাবে।’
যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান বলেন, ‘এটা ভালো তো, দল যেখানে যাকে দায়িত্ব দেয় তিনি সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। উনি দলের জন্য অবস্থান করছেন।’
ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহাজাহান বলেন, ‘একজন লোক যদি সার্বক্ষণিক দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করে দলের জন্য কাজ করেন- এটা তো নেগেটিভলি দেখার কোনো অবকাশ নেই। তিনি তো দলের জন্য কাজ করছেন। দলীয় কার্যালয় থেকে দলের জন্য আরও বেশি সময় দিতে পারছেন। অনেকের হয়তো এমন সুযোগ হয় না। সুতরাং এ সুযোগটা তার হয়েছে। তিনি ২৪ ঘণ্টা কার্যালয়ে অবস্থান করছেন- এটা আমরা পজিটিভলি দেখি।’
কেএইচ/এনডিএস/এমএআর/জেআইএম