আন্তর্জাতিক

আইবিএম-কোকাকোলাকে ভারত থেকে তাড়ানো প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মৃত্যু

ভারতের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও অভিজ্ঞ সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ জর্জ ফার্নান্দেস আর নেই। মঙ্গলবার ৮৮ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। ভারত পাকিস্তানের মধ্যে কারিগল সীমান্ত নিয়ে চলা উত্তেজনার সময় তিনি দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

Advertisement

বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, অনেকদিন ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় সাবেক এই মন্ত্রী আলঝাইমার ও পার্কিনসন্সে নামক স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া রোগে ভুগছিলেন। তাছাড়া গত কিছুদিন আগে তিনি সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হন। তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী জয়া জেটলি তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।

স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বর্ণময় রাজনীতিবিদদের একজন হলেন জর্জ ম্যাথিউ ফার্নান্দেজ। বুধবার ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এক সময় সোশ্যালিস্ট বা সমাজবাদী আন্দোলনের চ্যাম্পিয়ন ও পরে দক্ষিণপন্থী বিজেপির বন্ধুতে পরিণত হওয়া জর্জ ফার্নান্দেজের মতো আকর্ষণীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ভারতে খুব কমই তৈরি হয়েছে।

তার গোটা রাজনৈতিক জীবন ছিল অদ্ভূত বৈপরীত্যে ঠাসা। তার কারণেই ভারত থেকে এক সময় ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়েছিল জনপ্রিয় পানীয় প্রস্তুতকারক সংস্থা কোকা কোলা ও যুক্তরাষ্ট্রের সফটওয়্যার জায়ান্ট আইবিএম।

Advertisement

ভারতের শিল্পমন্ত্রী হিসেবে যেমন তিনি মার্কিন এই কোম্পানিগুলোকে দেশছাড়া করেছিলেন, তেমনি এক সময় তাকেই আবার মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র এজেন্ট হিসেবে অভিযুক্ত হতে হয়েছিল। রেলশ্রমিক আন্দোলনের নেতা হিসেবে মূলত তার ডাকা ধর্মঘটেই ১৯৭৪ সালে ভারতীয় রেলের চাকা থেমে গিয়েছিল প্রায় বিশ দিন। প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা দেশের লাইফলাইন।

সেই ফার্নান্দেজই আবার ১৯৮৯ সালে ভি পি সিংয়ের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে ভারতের রেলমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৭ সালে ভারতে মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে যে প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার দায়িত্ব নেয়, সেখানে জনসংঘের প্রতিনিধি অটলবিহারী বাজপেয়ী ও লালকৃষ্ণ আডবানিরা কেন আরএসএসের সদস্যপদ ছাড়বেন না - সেই প্রশ্ন তুলে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন জর্জ ফার্নান্দেজ।

এরপর নব্বইয়ের দশকে সমতা পার্টি গঠন করে জনসংঘের উত্তরসূরী বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোটের প্রধান সমন্বয়কারী হয়ে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর অতি আস্থাভাজন বলেও পরিচিতি পান তিনি। ১৯৯৮ সালে তিনি শপথ নেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে। যে পদে তিনি দু’দফায় প্রায় ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন।

সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও বার বার হিমাঙ্কের অনেক নিচের তাপমাত্রায়, সিয়াচেন হিমবাহের সীমান্তচৌকিতে সফর করে তিনি যেভাবে সেখানে মোতায়েন ভারতীয় সেনাদের মনোবল বাড়িয়েছিলেন তার জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

Advertisement

গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবিনেট মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও দিল্লিতে তার সরকারি বাংলোর দরজা সব সময় খোলাই থাকত, কোনও রক্ষীর বালাই ছিল না সেখানে। এমন কী সেই বাংলোতে মিয়ানমার বা তিব্বত থেকে ভারতে আসা শরণার্থীদেরও ছিল অবারিত দ্বার। তারা সেই বাসভবনের লনে রীতিমতো ক্যাম্প করে থাকতেন, পেতেন ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রশ্রয়ও।

কিন্তু সেই জর্জ ফার্নান্ডেজের বিরুদ্ধেই আবার অভিযোগ উঠেছিল, কার্গিল যুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনাদের জন্য নিম্ন মানের কফিন কিনে তার মন্ত্রণালয় ব্যাপক দুর্নীতি করেছে। ভারতের অনুসন্ধানী গণমাধ্যম ‘তেহলকা’র চালানো স্টিং অপারেশনে তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের দুর্নীতি ফাঁস হওয়ার পর ফার্নান্দেজ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে এক সময় পদত্যাগ করতেও বাধ্য হন।

দক্ষিণ কর্নাটকের এক গোঁড়া খ্রিষ্টান ক্যাথলিক পরিবারে জন্মানো জর্জ ফার্নান্দেজকে তার বাবা পাঠিয়েছিলেন যাজক হওয়ার জন্য। কিন্তু চার্চের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন মানতে না পেরে তিনি পালিয়ে যান মুম্বাইতে।

মুম্বাইয়ের চৌপাট্টিতে খোলা আকাশের নিচে তিনি বহু রাত কাটিয়েছেন। কাজ করেছেন খবরের কাগজেও। তারপর শ্রমিক আন্দোলনের সূত্র ধরে একটা সময় রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জীবনের শেষ দশ বছর অবশ্য তিনি রোগশয্যাতেই ছিলেন। আলঝাইমার ও পার্কিনসন্সে আক্রান্ত জর্জ ফার্নান্দেজের বাকশক্তি লোপ পেয়েছিল, এমন কী ঘনিষ্ঠজনদেরও চিনতে পারতেন না তিনি।

তবে দীর্ঘ কয়েক দশক জুড়ে ভারতের রাজনীতিতে জর্জ ফার্নান্দেজ যে অত্যন্ত প্রভাবশালী একটা নাম ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যেমন সত্তরের দশকের শেষ দিকে কোকা কোলার সঙ্গে তার সংঘাত ভারতে প্রায় লোকগাথার অংশ হয়ে আছে।

১৯৭৭-র সেপ্টেম্বরে দেশের শিল্পমন্ত্রী হিসেবে জর্জ ফার্নান্দেজ দাবি করেছিলেন, বহুজাতিক সংস্থা কোকা কোলাকে ভারতে তাদের ব্যবসার অন্তত ৬০ শতাংশ মালিকানা কোনও ভারতীয় সংস্থার হাতে তুলে দিতে হবে। শুধু তাই নয়, কোকা কোলা পানীয় প্রস্তুত করতে যে কনসেনট্রেট ব্যবহার করে, তার গোপন ফর্মুলাও ওই ভারতীয় সংস্থাকে জানাতে হবে বলে তিনি দাবি করেন।

গোটা বিশ্বজুড়ে ব্যবসা করলেও এই ফর্মুলা কোথাও ফাঁস করে না কোকা কোলা। ফলে তারা ভারত সরকারের ওই দাবিও মানতে রাজি হয়নি। সে বছরই তারা ভারত থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। প্রায় দেড় দশক পরে ভারতে প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাও ও অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে যখন আর্থিক উদারীকরণ চলছে তখন আবার কোকাকোলা ভারতে ব্যবসা করতে ফিরে আসে।

ভারতে ষাট বা সত্তর দশকে যাদের জন্ম, আজকের সেই মধ্যবয়সী বা প্রৌঢ়রা জর্জ ফার্নান্দেজকে অনেকেই মনে রাখবেন ভারত থেকে কোকা কোলাকে তাড়ানোর জন্য। তাছাড়া তিনি সফটওয়্যার জায়ান্ট আইবিএমকেও ভারত থেকে ব্যবসা গোটাতে বাধ্য করেন।

সূত্র : বিবিসি

এসএ/আরআইপি