আরো একটি নতুন সংসদের অধিবেশন চলছে। গঠন হয়ে গেছে মন্ত্রিসভা। কিন্তু আমার মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছের কোন কূলকিনারা হলো না। যদিও এই ইচ্ছের কূলকিনারা হওয়ার কথাও না। তবু ইচ্ছে বলে কথা।
Advertisement
আমাদের কিশোর বেলায় একটা গান খুব জনপ্রিয় ছিল। “হাল জামানার রাজনীতি ভাই রাজনীতি ভাই করতাছি যে আমরা সবাই”এই গান শুনেই আমার আমার প্রথম মন্ত্রী হওয়া ইচ্ছে। কারণ ওই গানে রাজনৈতিক নেতা এবং মন্ত্রী হওয়াটাকে নানা পথে বিদ্রুপ করা হয়েছিল।
রাজনীতি নিয়ে সেই বিদ্রুপের সঙ্গে আমি একমত ছিলাম না। এখনো নই। আমার মত, রাজনীতি মানুষের কল্যাণের অন্যতম পথ। দীর্ঘদিন সততার সঙ্গে যারা রাজনীতির পথে হাঁটেন, তাঁরাই মন্ত্রী হন। যে কারণে এই পথে হাঁটা খুব সহজ নয়। তাই আমার অবচেতন মনে যে কোন দামে ওই বিদ্রুপ ভুল প্রমাণ করার ইচ্ছে হতো।
এরও বেশ পরে নায়ক নামে একটা হিন্দি সিনেমা মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছেটা উস্কে দিয়েছিল আরেকবার। সেই ছবির মূল কথা ছিল, রাজনীতিতে সততা এবং অসতার যুদ্ধ। কখনো কখনো রাজনীতির সত্য এবং জীবনের সত্যের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়ার বার্তাটিও ছিল পরিষ্কার। সেই বার্তায় খুব স্পষ্ট ছিল, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই। তাই মানুষের কল্যাণের পথটাই সত্য।
Advertisement
‘নায়ক’ এর গল্পে নানা নাটকীয়তার পরও জয়ী হয়েছিল সাধারণ মানুষ। সেখানে একজন সাধারণ মানুষ মন্ত্রী হয়ে জিতিয়ে দিয়েছিলেন বহু পরাজিত মানুষকে। সিনেমা বলেই হয়তো পরাজিত মানুষ জিতেছিল। কিন্তু বাস্তবের গল্পতো ভিন্ন, বাস্তবে আমার চারপাশে তখনই প্রচুর হেরে যাওয়া মানুষ। তখন থেকে দেখতাম পদে পদে মিলে যাচ্ছে গানের বিদ্রুপ। জীবন দিয়ে বুঝতে পারতাম, আমার ওপর এসে পড়ছে গোয়েবলস সাহেবের তত্ত্ব।তাই শেষ চিকিৎসা হিসেবে, মন্ত্রী না হতে চেয়ে উপায় কী?
এখন একটা গল্প বলি। গল্পটা দু’জন বাবার । একটি চায়ের দোকানে বসে তারা কথা বলছেন। আলোচনার বিষয় স্কুলে বাচ্চা ভর্তি। একজন বাবা বলছেন ‘ভাই আমি নিশ্চিন্ত, ছেলেটাকে ভর্তি করতে পেরেছি’ আরেকজন বাবা প্রশ্ন করলেন করলেন, চান্স পেয়েছিল? তিনি বললেন আরে চান্স কী পায়? পাওয়াতে হয়।
আরেক বাবা আবার জিজ্ঞেস করলেন, তা কত লাগলো? তিনি বললেন ‘সব মিলিয়ে লাখ দুয়েক টাকা গেলো আর কী’। শুনে অপর বাবা বললেন, আর ভাই বলেন কেন, আমিতো তিন লাখ টাকা নিয়ে ঘুরলাম। লাইন পেলাম না। এভাবে অন্যের কথা শোনাটা ঠিক হচ্ছে না ভেবে লজ্জা পাচ্ছিলাম। কিন্তু যারা একটা শিশুর জীবনের শুরুই করাতে যাচ্ছেন একটা চুরির মধ্যদিয়ে তাদের কোন লজ্জাবোধ দেখলাম না। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই তারা কথা বলছিলেন। যেন এটাই নিয়ম।
শিক্ষার কথা যখন উঠলোই তখন বলতেই হয় স্কুলে স্কুলে কোচিং বাণিজ্যের কথা। পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের কথা। ঢাকা থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত সবখানেই ছেলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার প্রবণতা কমে গেছে। তবে সবাইকে বাধ্যতামূলক ভাবে কোচিংএ যেতে হয়। স্কুলে শুধু পরীক্ষা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে সবগুলো কোচিং চালান কিন্তু ওই স্কুলের শিক্ষকরাই। আর প্রশ্ন ফাঁস? সেতো জলভাতের চেয়েও সহজ। আমি তো অনেক বাবাকে ছুটতে দেখি, ছেলের জন্যে প্রশ্ন কিনতে।
Advertisement
স্বাস্থ্যখাতের কথা যদি বলি হাজারটা প্রশ্ন তোলা যাবে। রাজধানীর কথাই ধরা যাক। গাবতলী এলাকায় যদি কোন কম আয়ের মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় পড়লো। তাকে বাঁচাতে হলে যানজট ঠেলে ঢাকা মেডিকেলে নিতে হবে। অথচ রাস্তার দুই পাড়েই পড়বে অন্তত গোটা বিশেক বেসরকারি হাসপাতাল। অথচ কোথাও তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে জীবন রক্ষার চিকিৎসাটুকু দেয়ার সুযোগ নেই। আর কোন কারণে যদি ভর্তি করেও, হাসপাতালের বিল দিতে সহায় সম্বল সম্মান সব বিক্রি করতে হবে।
আবার কোন মানুষ যে সরকারি চিকিৎসার আওতায় আসবে সে সুযোগ কই ? তদবির অথবা ঘুষ ছাড়া আজকাল সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া দুরুহ। যদি হয়ও পড়ে থাকতে হয় মেঝেতে। সেখানে সবচেয়ে শক্তিধর হচ্ছে সিন্ডিকেট। তাদের হাতে কখনো কর্তৃপক্ষও জিম্মি। তাই নেহায়েত বিপদে না পড়লে মানুষ সরকারি হাসপাতালে যায় না।
শহরে শহরে এখন ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভিড়। সেখানেও বিনা বাধায় রয়েছে হাজারো প্রতারণা। এসব অব্যবস্থাপনায় পড়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। যেকোন মধ্যবিত্ত মানুষের ভিখিরি হয়ে হয়ে জন্যে পরিবারের কোন সদস্যের একটি জটিল রোগই যথেষ্ট ।
যোগাযোগ খাতের কথা না বললেই নয়। প্রতারণার নিত্য নতুন কৌশল সেখানে। স্বেচ্ছাচারের নজির বললেও ভুল নেই।যে কোন উৎসবের আগে পরে সেই স্বেচ্ছাচার প্রকাশ্য হয়। এই যোগাযোগ খাতকে নিয়মের মধ্যে আনতে একবার রাজপথে নেমে গেছে কোমলমতি শিশুরাও। লাভ হয়নি। যোগাযোগ খাতের স্বেচ্ছাচার যেখানে ছিল সেখানেই আছে।
অনিয়মের কথা বলতে গিয়ে মাত্র তিনটি খাতের কথা বলতে পারলাম। যদিও আর বলার দরকার নেই । এখান থেকেই প্রতিটি খাতের অনিয়ম নিয়ে গড় সিদ্ধান্তে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট। এই নিয়মিত অনিয়ম সবার জানা। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কল্যাণমূলক রাষ্ট্র, আইন, ন্যায়, সত্য এসব এখন আপেক্ষিক শব্দ। আর শক্তিশালী শব্দ হচ্ছে ‘তদবির’। যার আরেক নাম চাকা। যেটা না হলে চলা যায় না। এটা বাস্তবতা।
তবে এই অবস্থায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য যেটা, সেটা হচ্ছে প্রতিটি মানুষ ইচ্ছেয় হোক অথবা অনিচ্ছায় হোক, অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। প্রত্যেকেই ঠকছে এবং ঠকাচ্ছে। শিক্ষককে তো ভাল চিকিৎসা নিতে হবে। শুধু বেতনের ওপর ভর করে তো সেটা সম্ভব হচ্ছে না। আবার চিকিৎসককেও সন্তানকে মানসম্মত শিক্ষা দিতে হবে। তিনি কী করবেন নিয়মের বাইরে না গিয়ে? মানুষ যাতে আয় এবং ব্যয়ের সঙ্গতি রেখে জীবন ধারণ করতে পারে, সেরকম কোন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা তো নেই। এখানে চাইলেই বিনা বাধায় নিয়মের বাইরে যাওয়া যায়।
সাদা চোখেই মানুষকে এই অস্থির প্রতিযোগিতা থেকে বাঁচাতে পারে রাষ্ট্র। আর সেটাই রাষ্ট্রের কাজ। অথচ বছরের পর বছর মানুষ অস্থির জীবন যাপন করছে আমার দেশের মানুষ। কিন্তু তার শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন নিশ্চিত করার আইন হয় না আইন সভায়। আর হলেও এর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয় না।
সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থার আন্দোলনে শিশুরা তাদের দাবির মধ্যে প্রত্যেক মন্ত্রীর সপ্তাহে একবার গণপরিবহন চড়ার বিধান রাখতে বলেছিল। কারণ আর কিছু নয়, যারা আইন তৈরি করেন, তাদেরকে নিজের চোখে শিশুরা দেখাতে চেয়েছিল মানুষেরা কী ধরনের দুর্ভোগে পড়ে প্রতিদিন।
আমার মন্ত্রী হতে চাওয়ার বিষয়টাও অনেকটা এরকম। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে সমস্যায় পড়া মানুষের প্রতিনিধি আমি। তাই খুব শক্ত করে বলতে চাই, সংসদে জনবান্ধব আইন তৈরি হোক। যাতে আমার মত সাধারণ মানুষেরা ক্ষুব্ধ হয়ে মন্ত্রী হতে না চায় ...।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ।
এইচআর/পিআর