মতামত

৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকাও ‘কিছুই না’?

২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে পাচারের পরিমাণ ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। অবশ্য পাচারের পাশাপাশি, ২০১৫ সালে বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশেও অর্থ এসেছে। পরিমাণে তা ২৮০ কোটি ডলার। বাংলা টাকায় প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা। এসব তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি- জিএফআই।

Advertisement

প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে ১৪৮ উন্নয়নশীল দেশের টাকা পাচারের চিত্র। সংস্থাটি বলছে, উন্নত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ ভাগই পাচার হয়েছে নানা কৌশলে। পাচারকৃত টাকার বড় অংশই গেছে আমদানি-রফতানির সময়, পণ্যের প্রকৃত দাম গোপন করার মাধ্যমে। জিএফআই -এর হিসাবে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় ৮৯৭ কোটি ডলার বা প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা।

অংকের হিসাবে ২০১৫ সালে পাচারের পরিমাণ কমলেও জিএফআই বলছে, এটি আনুমানিক হিসাব। প্রকৃত পাচারের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুসারে, টাকার অংকের দিক থেকে ২০১৫ সালে অর্থপাচারে শীর্ষ ৩০ দেশের একটি ছিল বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। জিএফআই বলছে, টাকা পাচারের এ প্রবণতা টেকসই উন্নয়নের বড় বাধা।

এর আগে, লোপাট করা হাজার কোটি টাকাকে বলা হয়েছে- এ টাকা নাথিং। কিছুই না। পাচার করা টাকাকে বলা হয়েছে- পাচার নয়, এটা রফতানি। আর ঘুষের নাম দেয়া হয়েছে, স্পিডমানি। আগে-পিছে রাবিশ-ভোগাস ধরনের কথাবার্তারও খই ফুটেছে।

Advertisement

জিএফআইয়ের দেওয়া সদ্য দেওয়া পাচার তথ্য নিয়ে এখন পর্যন্ত সেই ধরনের কোনো কথামালা আসেনি। দেশে এখন চুনোপুটি পর্যায়ের লোকজনও যেই অংক ও হারে চুরি, দুর্নীতিতে পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছে ভবিষ্যতে এগুলোকে মামুলি, সামান্য বা মাত্র বলতে সময় লাগতে না-ও পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষক আবজাল হোসেন দেখিয়ে দিয়েছেন এই পর্যায়ের একজন কর্মচারীও কতো দূর যেতে পারেন? আবজালের স্ত্রী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টেনোগ্রাফার রুবিনা খানমও কম যাননি। তাদের দুর্নীতির ভয়াবহতা দুদক কর্মকর্তাদের পিলে চমকিয়ে দিয়েছেন। দুদকের অভিযোগ থেকে জানা যায়, আবজাল দম্পতির নামে রাজধানীর উত্তরায় ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডে রয়েছে তিনটি পাঁচতলা বাড়ি। উত্তরার ১১ নম্বর রোডে একটি প্লটও রয়েছে।

এছাড়া রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ও ফরিদপুরের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে তাদের অঢেল সম্পদ। অস্ট্রেলিয়ায়ও তাদের বাড়ির খোঁজ পেয়েছে দুদক। এ ধরনের অর্জন তাদের ব্যাপক উন্নয়নেরই উদাহরণ। নেতার উন্নয়ন দেশের উন্নয়ন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর উন্নয়নও দেশেরই উন্নয়ন। তারা দেশেরই জনগণ, ভোটার। অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখছে এই উন্নয়ন।

অর্থ মোহাচ্ছন্নদের জন্য বাগেরহাট ডিসি অফিসের উমেদার আবদুল মান্নান তালুকদারও প্রেরণার। ২৬ বছর চাকরি করে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেন ২০১০ সালে। চতুর্থ শ্রেণির এই কর্মচারী মাসে বেতন পেতেন সাকুল্যে হাজার পাঁচেক।

Advertisement

নিজেকে ‘সৎ ও ধার্মিক’ দাবি করা ‘চরমোনাই পীরের’ অনুসারী মান্নান এখন দুই-চার হাজার কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টারে চড়ে বিভিন্ন এলাকায় যেতেন তিনি। ৪০০ একর জমি, আটটি বিলাসবহুল গাড়ি ছাড়াও খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন শহরে মার্কেট, জুটমিলসহ তার রয়েছে অঢেল সম্পত্তি।

বাগেরহাট শহরে তার বাড়িটি শতাধিক সিসি ক্যামেরায় ঘেরা। সমিতি ও রিয়েল এস্টেটের মাধ্যমে তিনি দুই থেকে চার হাজার কোটি আত্মসাৎ করেছেন- এ অভিযোগ পেয়ে দুদক অনুসন্ধানে নামলে ‘গায়েব’ হয়ে যান উমেদার মান্নান। শোনা যায় সপরিবারে তিনি দেশ থেকে চম্পট দিয়েছেন।

১৯৮৪ সালে বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এমএলএসএস বা উমেদার পদে নিয়োগ পান এবং ২০১০ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন তিনি। মিঠাপুকুরে প্রি-ক্যাডেট মাদ্রাসার লাগোয়া তিনতলা ভবন তার কার্যালয় ও বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই বাড়িটিকে কার্যালয় হিসেবে দেখিয়ে ‘হলমার্ক গ্রুপের’ মতো নাম ও প্যাডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।

এমন মান্নান- আবজাল বাংলা মুল্লুকে অগণিত। তা জেনে-বুঝেই সরকারি একটি পিয়নের চাকরির জন্য লাখ-লাখ টাকা ছাড়তে কার্পণ্য করেন না বুঝবানেরা। চুনোপুঁটি নেতা, আতি-পাতিদের মতো সরকারি অফিসের পিয়ন-চাপরাশিও টাকার পাহাড় হাতাতে চায়।

তদ্দুর না পারলে টিলা হলেও গড়ে। যাবতীয় আলামত বলছে, দিনে দিনে আরও ভয়াবহ দুর্নীতিসহ সকল অপরাধ বাড়তেই থাকবে। ক্ষমতায় যেতে বা টিকে থাকতে যখন অপরাধ চালিকা শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন ভালো আশা করা দুষ্কর।

রাজনীতি, চাকরি, ব্যবসাসহ প্রতিটা সেক্টরের শেয়ানরা একে অন্যের সঙ্গে পেঁয়াজের খোসার মতো, রসুনের গোড়ার মতো যূথবদ্ধ। শাস্তির বদলে অবৈধ পথ ও পন্থায় দ্রুত সম্পদ অর্জন করার বিশেষ দক্ষতাবানদের পুরস্কৃত হওয়া অহরহই দেখছে মানুষ। তাদের একটাকে নিয়ে টানাটানি করলে শেষে পুরো সমাজেই 'ঠগ বাছতে গিয়ে গা উজাড়' হওয়ার দশা হতে পারে।

এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশি কথা বলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত ক্ষুব্ধ হয়ে তার অবস্থানকে সঠিক দাবি করে বলেছিলেন, হলমার্কের ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমি আবারও বলছি এটা একটা চুরি, জালিয়াতি।

যেখানে প্রতি বছর চার লাখ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ দেয়া হয় সেখানে এই চার হাজার কোটি টাকা কিছুই না- এটা আমি আবারও বলছি। দেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে যেভাবে চলছে এত ভালো আর কখনই ছিল না বলেও দাবি করে তিনি বলেছিলেন- শেয়ারবাজারের টাকা উধাও হয়নি। এ টাকার ভাগ দেশের কিছু লোকও পেয়েছে।

এ ভাবে খোলাসা করার পর কিন্তু আর কিছু বাকি থাকে না। বিষয়টাকে স্বচ্ছ-ট্রান্সপারেন্টও বলা যায়। সেই বিবেচনায় চুরি, দুর্নীতি বা বিভিন্ন দেশে টাকা পাচার হওয়ার তেমন নিউজভ্যালু আসলে থাকে না। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উন্নয়নের নির্দেশক হয়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের ভৌত অবকাঠামো বিনির্মাণ, যেখানে ব্যয় যৌক্তিক সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দফায় দফায়৷

এর মধ্য দিয়ে রেন্ট সিকিং বা অনুপার্জিত মুনাফাখোরীর পথকে প্রশস্ত করা হচ্ছে। আবার এক দেশের অর্থ অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার নানা ধরনের ব্যবস্থা বৈশ্বিকভাবেই রয়েছে৷ এ রকম একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো স্থায়ীভাবে অন্য দেশের অধিবাসী হওয়া ও কালক্রমে সে দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ৷ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে কোনো কোনো দেশের বিশেষত কথিত ট্যাক্স হেভেনগুলোয় স্বল্প সময়ের মধ্যে নাগরিকত্ব, তথা পাসপোর্ট পাওয়া যায়।

এসব দেশে কখনোই জানতে চাওয়া হয় না যে, টাকা কীভাবে বা কোথা থেকে আনা হলো৷ প্রয়োজনীয় টাকা এনে বাড়ি-জমি, কৃষিকাজ বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করলেই হলো। এ রকম বাস্তবতায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক "বাংলাদেশ ব্যাংকের" অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার বা প্রায় ৮০৮ কোটি টাকা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরির ঘটনা নিয়েও মাতবোল কমে এসেছে।

কেউ কেউ ভুলেও গেছে বা যাচ্ছে। ঝোক বুঝে তাই কারো কারো মধ্যে কোপ মারার একটা মানসিকতা আর লুকানো চাপানো থাকছে না। তুলনামূলক সৎ বা দুর্নীতিমুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যেও হাল বুঝে পাল তুলে কিছু হাতানোর মানসিকতা চাঙ্গা হচ্ছে।

দুদক পরিচালক এ কে এম ফজলুল হকের অনুসন্ধানের তথ্য ফাঁস এবং আসামির সঙ্গে গোপন যোগাযোগ করে লাভবান হওয়ার ঘটনাও সেই আদলের বলে ধারণা কারো কারো। ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত তার সম্পর্কে এ ধরনের সন্দেহ তেমন ছিল না। সৎ-ভালো কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতিও পেয়েছিলেন কয়েকদিন আগে। সেই ব্যক্তিই বন বিভাগের এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সম্পদের অনুসন্ধানে দীর্ঘ ১৩ মাস সময় নেন।

তিনি অনুসন্ধান সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নথির কাগজপত্র বেআইনিভাবে এক কর্মচারীর মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হাতে হাতে দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে গত ১৪ জানুয়ারি হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় বিষয়টি। কিন্তু শেষমেষ কি হবে সেটা পরের বিষয়। তার চেয়ে বড় কথা এসব ঘটনা ভুলে যেতে মানুষের সময়ও লাগে না। সবমিলিয়ে এগুলো কিছুই না।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর