প্রতিটি জেলা উপজেলায় অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের পাকা ঘর করে দেয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। পাঁচতলা ওইসব ভবনে লিফ্ট না থাকায় বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধাদের উঠা-নামায় অসুবিধা হবে। আবার ভবনের প্রস্তাবিত জায়গায় এই বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধাদেরই কাজ করার সুযোগ কম থাকবে এমন বেশকিছু কারণে প্রকল্পটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
Advertisement
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, ‘প্রতি জেলা/উপজেলায় অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ’ প্রকল্পটি আপাতত প্রত্যাহার হলেও বড় পরিসরে বাস্তবায়ন করা হবে। তবে অনেকে বলছেন, প্রকল্পের জটিলতা দূর করে অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের স্বার্থে এটি প্রত্যাহার করা উচিত হবে না।
‘মুক্তিযোদ্ধাদের বহুতল বাড়িতে উঠা-নামায় সমস্যা হবে’, এই ধরনের কারণ কতটা যৌক্তিক?
জবাবে সোমবার (২৮ জানুয়ারি) রাতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবশ্যই যৌক্তিক। এখন তো মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স ৭০ বছরের নিচে নাই। আমি মনে করি, খুবই যৌক্তিক।’
Advertisement
লিফ্ট করে দিলেই তো সমস্যার সমাধান করা যায়। সে পথে গেলেন না কেন? জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘যেটা মুক্তিযোদ্ধারা চাচ্ছে, সেটাই আমরা করছি।’
আরও পড়ুন>কুমিল্লায় ৬১ মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধিত
ভবনগুলো এমন জায়গায় নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে সমস্যার কথা বলা হয়েছে। যদি তাদের বয়স ৭০ বছরের বেশিই হয়, তাহলে তাদের কাজের প্রসঙ্গটি আসছে কেন?
উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ‘তাদের পরিবারের লোকজন আছে না? তারা কাজ করবে না?’
Advertisement
২২ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) নতুন সরকারে প্রথম জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রত্যাহারের জন্য এই প্রকল্পটি উত্থাপনের কথা ছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী উপস্থিত না থাকায়, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
প্রকল্প প্রত্যাহারের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়, প্রকল্পের বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া, ফ্ল্যাটের মালিকানা, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত জটিলতা, বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য চিহ্নিত, প্রস্তাবিত এলাকা কিংবা নিকটবর্তী এলাকায় সুবিধাভোগী মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মসংস্থানের সুযোগের অপ্রতুলতা, বহুতল ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ এবং লিফ্টবিহীন পাঁচতলা ভবনে বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধাদের উঠা-নামার অসুবিধা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে জেলা উপজেলা পর্যায়ে ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিবর্তে ভূমিহীন ও অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের নিজ বসতভিটায় কিংবা প্রয়োজনে সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে একতলা বিশিষ্ট বাসস্থান নির্মাণ করাই যথার্থ হবে।
এ রকম পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা কমিশন সুপারিশ করেছে, একনেক সভায় প্রকল্পটি প্রত্যাহারের জন্য।
এ বিষয়ে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘প্রকল্পটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে নতুন করে করার জন্য। বেশি সংখ্যক বাড়ি নিয়ে এই প্রকল্পটি করব আমরা। আমরা ইনডিভিজুয়াল (প্রত্যেককে আলাদা) বাড়ি করে দেব। যেখানে তাদের বাড়িঘর ছিল সেখানে। যাদের জমিজমা নাই, তাদেরকে সরকারি জায়গায় বাড়ি করে দেব একক ইউনিট হিসেবে।’
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়েপড়া অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের বাসস্থান করে দেয়ার মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে এই প্রকল্পটি হাতে নেয় সরকার। ১৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে পাঁচতলা বিশিষ্ট ৫৩২টি ভবন করার কথা ছিল। যেখানে থাকবে ৯৮২ বর্গফুটের মোট ৮ হাজার ফ্ল্যাট। এ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ সড়ক, লাইটিং ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা ইত্যাদির সুবিধাও রাখা হয়েছিল প্রকল্পে। এজন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে একশ কোটি টাকা বরাদ্দও দেয়া হয়।
আরও পড়ুন>‘এ দেশের নদীও মুক্তিযোদ্ধা’
প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য একনেক সভায় গৃহীত হয়। এজন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ২৭৩ কোটি ২১ লাখ টাকা, যার পুরোটাই সরকারের অর্থায়নে করার কথা ছিল।
একনেকে প্রকল্প অনুমোদন হলেও পুনর্গঠিত ডিপিপি এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়নি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। যার জন্য প্রকল্পের অনুমোদন আদেশ জারি করেনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। অনুমোদন আদেশ জারি না হওয়ায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়নি।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা অস্বচ্ছল আছে, তাদের সহায়তা করা দরকার। আমি আশা করব, প্রকল্পের মধ্যে যদি ত্রুটি থাকে, তাহলে তা নতুন করে প্রণয়ন করবে এবং বাস্তবায়ন করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ত্রুটি তো থাকতেই পারে। আমি মনে করি, সরকার সদিচ্ছা পোষণ করবে এবং নতুন করে প্রণয়ন করে বাস্তবায়ন করবে।’
এর ফলে গত সরকারের শেষ সময়ে এসে নেয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে অনেক প্রকল্প প্রত্যাহার হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলেও মনে করেন সুজন সম্পাদক। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমি আশা করি, সরকার বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন এবং সঠিক প্রকল্প বেছে নেবেন।’
পিডি/এমআরএম/আরআইপি