জাতীয়

বিদেশে মাদক ব্যবসায় ‘স্মার্ট মেয়েরা’

বায়িং হাউজে চাকরির নামে চলতো নিয়োগ। প্রাধান্য পেতেন কথিত ‘স্মার্ট মেয়েরা’। নিয়োগের পর তাদের (স্মার্ট মেয়েরা) দিয়ে দেশের ভেতর মাদক সরবরাহ ও ব্যবসার কাজ করানো হতো। এক সময় পারদর্শী হয়ে উঠলে পাঠানো হতো বিদেশে।

Advertisement

মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এর আগে সোমবার (২৮ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের ৫ সদস্যকে আটক করে র‌্যাব।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে বিশেষ অভিযানে ২৭২ কেজি হেরোইন ও ৫ কেজি কোকেনসহ মো. জামাল উদ্দিন ও রাফিউল ইসলাম নামক দুই বাংলাদেশি গ্রেফতার হয়। তার কয়েকদিন পর ৩২ কেজি হেরোইনসহ বাংলাদেশি নাগরিক সূর্যমণি গ্রেফতার হয়। ১ মাসের মধ্যে হেরোইন ও কোকেনসহ বাংলাদেশি গ্রেফতারের ঘটনাটি তদন্তে বাংলাদেশে একটি ট্রাক্সফোর্স গঠন করা হয়।

ট্রাক্সফোর্সের অভিযানে গত ১২ জানুয়ারি (শনিবার) আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে চয়েজ রহমান নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তার বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করা হয়। সেই মামলার ছায়া তদন্তে নামে র‌্যাব।

Advertisement

এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার (২৮ জানুয়ারি) রাজধানীর বিমান বন্দরের পাশে কাউলা এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ৯৭০ পিস ইয়াবা, বৈদেশিক মুদ্রা ও পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়।

গ্রেফতাররা হলেন- ফাতেমা ইমাম তানিয়া (২৬), আফসানা মিমি (২৩), সালমা সুলতানা (২৬), শেখ মোহাম্মদ বাধন ওরফে পারভেজ (২৮), রুহুল আমিন ওরফে সায়মন (২৯)।

মুফতি মাহমুদ জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান চক্রের সাথে সম্পৃক্ত বলে জানায়। বাংলাদেশে তাদের নিয়ন্ত্রক মো. আরিফ উদ্দিন। আরিফ উদ্দিনের আল-আমিন ফ্যাশন বায়িং হাউস নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেই ব্যবসার অন্তরালে আন্তর্জাতিক মাদক সিন্ডিকেটের সাথে তিনি জড়িত।

Advertisement

গ্রেফতারদের জানামতে আরিফ উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে মাদক সিন্ডিকেটে বাংলাদেশি ১৫-২০ জন যুক্ত রয়েছে। এই সিন্ডিকেট দেশের অভ্যন্তরেও মাদক (ইয়াবা) ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বলে জানতে পেরেছে র্যাব।

গ্রেফতারদের বরাত দিয়ে মুফতি মাহমুদ জানান, আরিফ নিজে রিক্রুটিং করত, এছাড়া রেহানা এবং গ্রেফতার রুহুল আমীন ওরফে সায়মন রিক্রুটিংয়ের কাজ করতেন। রিক্রুটিংয়ের ক্ষেত্রে মূলত স্বল্প শিক্ষিত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত স্মার্ট মেয়েদেরকে প্রাধান্য দেয়া হতো। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমে তাদেরকে ব্যবসায়িক কাজে নিয়োজিত করা হতো। এরপর বিশ্বস্তদের দেশের অভ্যন্তরে তাদের মাদক সংগ্রহ, সরবরাহ ও বিতরণের জন্য ব্যবহার করা হতো।

পারদর্শী হয়ে উঠলে তাদেরকে বিদেশে পাঠিয়ে বিদেশি কালচারের সাথে অভ্যস্ত এবং পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা হতো। পরে তাদেরকে বিদেশে মাদক সরবরাহ ও বিতরণের কাজে ব্যবহার করা হয়। তাদের মাদক সিন্ডিকেটের আফগানিস্তান, পাকিস্তান, চীন, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কায় নেটওয়ার্ক রয়েছে। মাদক পরিবহনে তারা বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে।

আটকদের পরিচয়ের বিষয়ে র‌্যাব জানায়, ফাতেমা ইমাম তানিয়া শরিয়তপুরের বাশবাড়িয়া গালর্স স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যায়ন করেছে। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ২০১৬ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিং করার সময় সহপাঠী ফারহানার ও আটক রুহুল আমিনের মাধ্যমে রেহানার সাথে পরিচয় হয়। রেহানার প্ররোচনায় ও প্রলোভনে ২০১৬ সালে এ মাদক সিন্ডিকেটের সাথে সে যুক্ত হয়। এখন পর্যন্ত দুইবার ভারতে, তিনবার চীন এবং ৮ থেকে ১০বার মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেছেন।শ্রীলঙ্কায় মাদক ব্যবসার জন্য তাদের ৪টি ভাড়া বাসা রয়েছে।

গ্রেফতার আফসানা মিমি ২০১৫ সালে মিডিয়া জগতে কাজ করার জন্য ঢাকায় আসেন। সে নাচ, গান এবং অভিনয়ে পারদর্শী এবং ঢাকার একটি ডান্স ক্লাবের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার কর্মক্ষেত্রের সূত্রে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কর্মরত রুহুল আমীন সায়মনের সাথে পরিচয় হয়। পরে রুহুল আমীনের মাধ্যমে রেহানা ও পরবর্তীতে আরিফের সাথে পরিচিত হয়।

আরিফের সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হলে ২০১৭ সালে এই মাদক সিন্ডিকেটে যুক্ত হন তিনি। ২০১৭ সালে সে আরিফের সাথে মালয়েশিয়া যায়। সেখান থেকে সে এবং রেহানা মাদকের একটি চালান নিয়ে শ্রীলঙ্কায় যান।

সালমা সুলতানা ২০১০ সালে এইচএসসি পাসের পর পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কাজ শুরু করেন। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট চাকরির সময় গ্রেফতার ফাতেমা ইমাম তানিয়ার মাধ্যমে রেহানার সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ২০১৭ সাল থেকে সে এই চক্রের সাথে যুক্ত। মাদক সিন্ডিকেটে কাজ করার জন্য চীন, শ্রীলঙ্কা ও ভারতে গিয়েছেন।

মো. বাধন ওরফে পারভেজ একটি বায়িং হাউজে কাজ করতেন। সে ২০১৭ সালে আরিফের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন এবং আরিফের নির্দেশনায় ২০১৮ সালে দুইবার শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১ মাসের বেশি সময় অবস্থান করেন। সেখানে মাদকদ্রব্য প্যাকেজিং, সংগ্রহ ও সরবারহ করতেন তিনি।

রুহুল আমীন ওরফে সায়মন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কর্মরত। আত্মীয়তার সূত্রে রেহানা আক্তারের মাধ্যমে সে এই চক্রের সাথে যুক্ত হন। রেহানার নির্দেশনায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মহিলাদের প্রলোভনে ফেলে মাদক সিন্ডিকেটের সাথে যুক্ত করেন তিনি। এছাড়াও এই মাদক সিন্ডিকেটের জন্য পাসপোর্ট, ভিসা এবং টিকিটিং ইত্যাদি কাজ করতেন তিনি।

গ্রেফতার ৫ জনের বিরুদ্ধে র‌্যাব মামলা দায়ের করবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

এআর/আরএস/এমকেএইচ