অর্থনীতি

খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

>> সেপ্টেম্বর শেষে বিতরণ ৮ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা>> খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা>> খেলাপি ঋণ কমাতে ‘দৃশ্যমান শাস্তির’ সুপারিশ

Advertisement

সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অব্যবস্থাপনা ও নানা অনিয়মের মাধ্যমে দেয়া ঋণ আর আদায় হচ্ছে না। ফলে বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ। এতে পুরো ব্যাংক খাতে এখন নড়বড়ে অবস্থা। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে সরকার।

খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে নিয়মনীতি বাস্তবায়নে কঠোর হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সব মহলের চাপে তৎপরতা শুরু করেছেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমনটি জানা গেছে।

ঋণের সুদহার এক অংকে (সিঙ্গেল ডিজিট) নামানোর প্রধান বাধা নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) বা খেলাপি ঋণ। এটি কমাতে না পারলে ব্যাংক খাতের অবস্থা আরও নাজুক হবে। তাই ঋণ খেলাপির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর হতে হবে। একই সঙ্গে এ খাতে সুশাসন ফেরানোর পাশাপাশি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

Advertisement

এদিকে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে সরকার। নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে এ বিষয়ে শর্ত জুড়ে দেন।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বৈঠকে বসার আগেই আমার শর্ত ছিল একটা। কোনো কিছু আলাপ করার আগে আমার এক দফা। আজকের পর থেকে খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়তে পারবে না। আপনারা কীভাবে বন্ধ করবেন, কীভাবে টেককেয়ার করবেন, কীভাবে ম্যানেজ করবেন; তা আপনাদের ব্যাপার’।

সরকারের চাপে ইতোমধ্যে তৎপরতা শুরু করেছেন ব্যাংক চেয়ারম্যানরা। কীভাবে খেলাপি ঋণ কমানো যায়- সেই কৌশল নির্ণয়ে ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন পরিচালকরা।

এ বিষয়ে বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (বিএবি) সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। এটি কমানোর বিভিন্ন উপায় খোঁজা হচ্ছে।

Advertisement

তিনি বলেন, নতুন অর্থমন্ত্রী ব্যাংক খাত সংস্কারসহ বেশকিছু শর্ত ও পরামর্শ দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত হচ্ছে খেলাপি ঋণ কমানো। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি।

বিএবি সভাপতি বলেন, 'খেলাপি ঋণ কয়েকটি স্তরে বিন্যাস করতে চাচ্ছি। এর মধ্যে ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত খেলাপি চিহ্নিত করা। এটি কোন প্রক্রিয়ায় আলাদাভাবে নির্ণয় করা যায়; সেই কৌশল খোঁজা হচ্ছে। এছাড়া যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি, তাদের কীভাবে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা যায়, সে বিষয়ে জোর দেয়া হচ্ছে।’

এদিকে খেলাপি ঋণ কমাতে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে ব্যাংকগুলোর পুনঃঅর্থায়ন নীতিমালা পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। নতুন নীতিমালায় ৮ শতাংশ বা তার বেশি কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়নের অযোগ্য বিবেচিত হবে। বর্তমানে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ বা তার বেশি হলে পুনঃঅর্থায়নের অযোগ্য বিবেচিত হয়। পুনঃঅর্থায়নের বিষয়ে নতুন এ নির্দেশনা শিগগিরই প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করে ব্যাংকগুলোতে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে এসএমই, কৃষিভিত্তিক শিল্প, গবাদি পশু চাষ, তৈরি পোশাক খাত, প্লাস্টিক ও চামড়া কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ কয়েকটি খাতের জন্য পুনঃঅর্থায়ন তহবিল চালু আছে। এ তহবিল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ব্যাংকরেট’, অর্থাৎ ৫ শতাংশ সুদে অর্থ দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন নেয়। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে গ্রাহক থেকে আদায় করে তা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে। এসব তহবিল থেকে ঋণ বিতরণের জন্য চুক্তির সময় খেলাপি ঋণ, ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর), মূলধন পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয় যাচাই করা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে অর্থ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। পুনঃঅর্থায়নের বিষয়ে নতুন এ নির্দেশনা জারি হলে সরকারি-বেসরকারি ১৭টি ব্যাংক পুনঃঅর্থায়ন নিতে পারবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো যাচাই-বাছাই না করেই নামে-বেনামে ঋণ দিচ্ছে। ঋণের অর্থ নিয়মিত আদায় হচ্ছে না। আবার বিশেষ সুবিধায় এসব ঋণ পুনর্গঠনও করা হচ্ছে। তারপরও ঋণের অর্থ পরিশোধ করছে না। ফলে বেড়েই চলছে খেলাপি ঋণ। এ খেলাপি ঋণই এখন ব্যাংকের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ খেলাপির বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয়। এটি রাখতে গিয়ে অনেক ব্যাংক মূলধনও খেয়ে ফেলছে।

তিনি বলেন, ঋণ খেলাপি ও নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকারদের দৃশ্যমান শাস্তি না দিলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয়। তাই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন সাবেক এ গভর্নর।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে এখন বড় সমস্যা নন-পারফর্মিং ঋণ (এনপিএল বা খেলাপি)। এটি কমাতে পারলে ঋণ বিতরণ বেড়ে যাবে। খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে যেখানে এনপিএল ১১ শতাংশ ছিল তা সিঙ্গেল ডিজিটে (এক অংকে) নামিয়ে আনা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ একটি সংবেদনশীল বিষয়। ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে নামানোর প্রধান বাধা নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) বা খেলাপি ঋণ। ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ ও বিনিয়োগবান্ধব করতে খেলাপি ঋণ কমানোর কোনো বিকল্প নেই। এ সমস্যা সমাধানে ব্যাংক খাতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি বলেও জানান তিনি।

‘ঋণ খেলাপি দুই ধরনের হয়ে থাকে’ উল্লেখ করে ব্যবসায়ীদের এ নেতা বলেন, ‘ব্যবসায় মন্দার কারণে কেউ খেলাপি হয়, তাদের সহযোগিতা করতে হবে। আবার অনেকে খেলাপি হয় ইচ্ছাকৃতভাবে। ওই দুষ্ট চক্রের কারণে ব্যাংক খাতে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।’ তাদের চিহ্নিত করে আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়ার দাবি জানান তিনি।

এদিকে ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে সর্বাধিক সমালোচিত হয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। তাই নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ অধিকতর কার্যকর ও শক্তিশালী করা হবে।

এসআই/এমএমজেড/এমএআর/এমএস