জাতীয়

বিরোধ মিটিয়ে সরোয়ার-তামিমকে এক করে শরিফুল

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থেকে গ্রেফতার হলি আর্টিসান হামলা মামলার এজহারভুক্ত আসামি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক রেজাউল করিমকে হত্যা মামলার আসামি শরিফুল ইসলাম জেএমবির আমির সরোয়ার জাহান ও শীর্ষনেতা তামীম চৌধুরীকে এক করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

Advertisement

শুক্রবার শরিফুল ইসলাম ওরফে খালিদ ওরফে রাহাত ওরফে সাইফুল্লাহ ওরফে নাহিদ ওরফে আবু সোলাইমানকে (২৭) গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপর আজ কারওয়ানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে তার বিষয়ে নানা তথ্য জানানো হয়।

র‌্যাব বলছে, সরোয়ার ও তামিমকে যুক্ত করার পর নির্দেশনা আসে রেজাউল করিমকে হত্যার। একই এলাকার ও একই বিভাগের ছাত্র ও জেএমবি নেতা শরিফুলের ওপর সে ‘দায়িত্ব’ পড়ে। রেজাউল করিমকে হত্যার পর আত্মগোপনে যায় শরিফুল। গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারীও তিনি। আত্মগোপনে থেকেই জেএমবি নেতা সারোয়ার জাহানের কাছে হামলায় ব্যবহৃত ৩৯ লাখ টাকা টাকা পাঠানো হয়; যে অর্থগুলো আসে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ থেকে।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।

Advertisement

কে এই শরিফুল

শরিফুলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে মুফতি মাহমুদ খান জানান, ১৯৯১ সালে জন্মগ্রহণ করা শরিফুল বাগমারা পাইলট হাইস্কুল থেকে ২০০৮ সালে এসএসসি এবং রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ থেকে ২০১০ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ প্লাস পায়। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০-১১ সেশনে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়।

যেভাবে জঙ্গিবাদে

২০১৩ সালে অনার্স ৩য় বর্ষে পড়ার সময় আহসান হাবিব শোভন নামে একজনের হাত ধরে উগ্রবাদে জড়ায় শরিফুল। প্রথমদিকে জেএমবির সঙ্গে জড়িত না হলেও রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ কেন্দ্রিক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত সমমনাদের নিয়ে গঠিত একটি উগ্রবাদী গ্রুপ পরিচালনা করতেন।

Advertisement

মাদরাসাকেন্দ্রিক জঙ্গিবাদের ধারণা থেকে বেরিয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের নিয়ে উগ্রবাদী গ্রুপ গড়ে তোলেন এবং অনলাইনে উগ্রবাদ প্রচারণা করতেন তারা। পরবর্তীতে শোভনের মাধ্যমে জেএমবি নেতা তামিম চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় শরিফুলের।

শরিফুলের চেষ্টায় এক হন সরওয়ার-তামিম

২০১৩ সালে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ২০১৪ সালে জঙ্গিবাদের বিভিন্ন মতাদর্শের লোকজনকে এক করার কাজ করেন শরিফুল। শোভন ও শরিফুল একই মেসে থাকতেন। সে সময় তামিম চৌধুরী রাজশাহী এলাকায় গেলে তাদের মেসে রাত্রিযাপন করতেন। মতবিরোধ মিটিয়ে জেএমবি নেতা সারোয়ার জাহান ও তামিম চৌধুরীকে একসঙ্গে যুক্ত করতে শরিফুলের বিশেষ ভূমিকা ছিল।

২০১৫ সালে রিপনের বগুড়ার বাসায় সারোয়ার জাহান, তামিম, সাদ্দাম, মারজান ও সাকিব মাস্টার একত্রে বৈঠকেও মিলিত হন। মিটিংয়ে শরিফুল উপস্থিত ছিলেন এবং সংগঠনের মিডিয়া উইংয়ের দায়িত্ব পান।

মুফতি মাহমুদ খান বলেন, হলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গাইবান্ধার একটি আস্তানায় একটি বৈঠক হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় বিভিন্ন বৈঠকেও শরিফুল অংশ নেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যার ব্যাপারে শরিফুল প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দিয়েছে বলেও জানিয়েছে র‌্যাব।

যেভাবে রেজাউলকে হত্যা

এ ব্যাপারে শরিফুল র‌্যাবকে জানায়, সংগঠনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্থানীয় জঙ্গি সদস্যদের মাধ্যমে রেকি ও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত, যেমন: ঠিকানা, ফোন নম্বর সংগ্রহ এবং অবস্থান ও গতিবিধি নজরদারি করা হয়েছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এইচএসসির ছাত্র ও জঙ্গি সদস্য রিপন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকদের ক্লাসের রুটিন মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে শরিফুলকে দেয়। ওসমান মিলু ও মাসকাওয়াত ওরফে আব্দুল্লাহ হত্যার কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি সংগ্রহ করে নিয়ে আসে।

শরিফুলের নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয়। হত্যাকাণ্ড শেষে হাসান ওরফে বাইক হাসান মোটরসাইকেলে শরিফুল ও খাইরুল ইসলাম ওরফে পায়েলসহ রওনা দিয়ে খরখড়ি বাইপাসের কাছে পায়েলকে নামিয়ে দেয়। পায়েল চাপাতি, রক্তমাখা কাপড় চোপড়ের ব্যাগ নিয়ে যায়। বাইক হাসান ও শরিফুল তাহেরপুর হয়ে নাটোরে বাইক হাসানের ভাড়া বাসায় ওঠে। পরদিন সে ঢাকায় চলে যায়।

আর্টিসান হামলা : মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে ৩৯ লাখ টাকা

ঢাকায় ২-১ দিন অবস্থান করার পর আমিরের নির্দেশে আত্মগোপণে চলে যায় শরিফুল। এ সময় অপর জঙ্গি নেতা রিপন তার সঙ্গে ছিল। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় শরিফুল ও রিপন ৩৯ লাখ টাকা সারোয়ার জাহানের কাছে পাঠায়, যা হলি আর্টিসানে হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে। এই অর্থ মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ থেকে তাদের কাছে এসেছিল বলে জানায় শরিফুল।

মুফতি মাহমুদ খান আরও বলেন, ২০১৭ সালের শেষদিকে আত্মগোপন থেকে প্রকাশ্যে আসেন শরিফুল এবং ২০১৮ এর শুরুর দিকে প্রকাশ্যে আসেন রিপন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে জেএমবির শীর্ষ নেতাদের অনেকেই মারা গেছেন এবং অনেকে গ্রেফতার হন।

জেএমবিকে স্তিমিতাবস্থা থেকে পুনরায় উজ্জীবিত করে এবং নতুন সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে জেএমবিকে ফের সংগঠিত করতে চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন তারা। গত সপ্তাহে হলি আর্টিসান মামলার আরেক আসামি রিপনকে গ্রেফতার করা হয়। রিপনের দেয়া তথ্য ও গোয়েন্দা অনুসন্ধানের ভিত্তিতে শুক্রবার শরিফুলকে গ্রেফতার করা হয়।

জেইউ/এনএফ/এমকেএইচ/এসজি