প্রবাস

প্রবাসীদের কদর নেই, আছে অবহেলা!

আমাদের দেশে প্রবাসীদের কদর নেই, আছে অবহেলা। একজন প্রবাসী দেশের জন্য কাজ করতে গিয়েও যতটুকু অবহেলা সহ্য করে আত্মসম্মানের বোধ ত্যাগ করে কাজ করে সেটা আসলে বাংলাদেশ কখনোই বোঝেনি বা বোঝার চেষ্টা করেছে বলে মনে হয় না।

Advertisement

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই প্রতিবছর কাজের সন্ধানে হাজারো শিক্ষিত-অশিক্ষিত যুবক মধ্যেপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছেন। জীবনের গুরত্বপূর্ণ সময়টি প্রবাসে ব্যয় করছে এসব যুবক। সোনার হরিণের পেছনে ছুঁটতে ছুঁটতে অনেক প্রবাসী যুবকের বিয়ের বয়স পার হয়েও যাচ্ছে। বিনিময়ে কি পাচ্ছে তারা?

কেন এমন তা হয়তো আমার জানা না থাকলেও জানা আছে সরকার কিংবা সরকারের উচ্চপদস্থ নেতাদের। আমাদের দেশে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রবাসীরা যদি দেশ ত্যাগ করে না যেত তাহলে দেশ আর দেশের মতো থাকত না। দেশ বৃন্দাবনে চলে যেত। ব্যাপারটা অনেকটা হাস্যকর মনে হলেও তা সত্যি।

প্রবাসীদের নিয়ে যেভাবে খেলা চলছে তাতে দিনদিন প্রবাসীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতির চাকা। প্রবাসে ফ্রি ভিসায় শ্রমিক পাঠানোর নামে প্রবাস যাত্রীর ভিসা প্রসেসিং খরছ চারগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভিসা প্রসেসিং খরছ ১ লাখ ৬৫ হাজার হলে ৩ লাখ নেয়া হয়। করা হয় নানা ভাবে প্রতারণা। প্রবাসীদের যেমন জুলুম করা হচ্ছে তেমনি ভিসার মালিকদেরকে (কফিল) প্রসেসিং ব্যয় বাড়িয়ে বাংলাদেশি শ্রমিক নিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

Advertisement

যারা প্রবাসে চলে গেছেন দেশ ছেড়ে তাদের আপনজন ছেড়ে তাদের ভাবনায় শুধু একটা ভাবনাই থাকে, আমার মা ভালো আছে তো! আমার বাবা ভালো আছে তো! আমার সন্তানরা ভালো আছে তো! এই ভাবনাগুলো তাদের আরো ভাবিয়ে তোলে যে, তাদের যত কষ্টই হোক না কেন তাদের উপার্জন করতে হবে।

তখন তারা বুকে পাথর চাপা দিয়ে কাজে নেমে যায়, যে নেমে যাওয়ার মধ্যে আর কোনো দ্বিধা থাকে না, দ্বন্দ্ব থাকে না, থাকে শুধু একটাই ভাবনা যে, আমাকে ভালো কিছু করে দেশে গিয়ে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। যে ফোটানোর মধ্যে কোনো ক্লান্তি থাকবে না, ক্লেদ থাকবে না, তৃষ্ণা থাকবে না, থাকবে না এর কোনোকিছু।

কেননা তারা তাদের কথা ভেবে প্রবাসে যায় না, তারা তাদের পরিবারের কথা, দেশের কথা ভেবে বিদেশ যায়। গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারা অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠায়। দেশ থেকে একজন মানুষ যখন প্রবাসে যায় তখন তার ভাবনায় সবচেয়ে আগে যে ভাবনাটা থাকে সেটা হলো আমাকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে, যে অর্থ দিয়ে আমি বিদেশে এসেছি আমাকে তা শোধ করে পরিবারের জন্য কিছু নিয়ে দেশে ফিরতে হবে। যে ফেরার মধ্যে থাকবে মমতা বা পাওয়ার ফেরা এবং তার কোনো কিছুর পাওয়ার ইচ্ছা পূরণের আকাঙ্খা।

দেশের সঙ্গে প্রবাসীদের সম্পর্ক গভীর হয়েও গভীর হতে পারে না, তার কারণ প্রবাসীদের কখনোই দেশ সম্মানের চোখে দেখে না বা তাদের মূল্যবোধের জায়গাটা দেয় না। কারণ প্রবাসীরা দেশের বাইরে থাকে বলে। প্রবাসীরা দেশের জন্য দেশ ছেড়ে যায় অন্য দেশে এটা বুঝলেও বোঝে না দেশের মানুষ।

Advertisement

বেশ বড় বড় মানুষ বলে, প্রবাসীরা দেশ ছেড়েছে দেশের প্রতি তাদের মায়া, দেশের প্রতি তাদের টান নেই বলে, কিন্তু তারা এটুকু বোঝে না বা এটুকু বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই যে, আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের অভাবেই তারা দেশ ছেড়েছে, আমাদের দেশের মানুষজনদের ভালো রাখার জন্য তারা দেশ ছেড়েছে। দেশ প্রবাসীদের ভুলে গেলেও প্রবাসীরা কখনো দেশের কথা ভোলে না, তারা ভুলতে পারে না, কেননা সে সেদেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হতে পারে। সুতরাং বলা যায়, প্রবাসীদের সঙ্গে দেশে সম্পর্কটা ততটা বন্ধুত্বপূর্ণ না হলেও দেশের প্রতি প্রবাসীদের একটা টান আছেই শুরু থেকে।

কেননা তারা তাদের আপনজনদের দেখা পাওয়ার জন্য যেখানেই যাক না কেন সবশেষে তাদের দেশেই ফিরে আসতে হয়, মা বলে ডাকার জন্য নিজের গ্রামটার মনোমুগ্ধকর প্রতিচ্ছবি তাকে বার বার দেখায় যেন তার টান, দেশের প্রতি তার মায়া আরো তীব্র হয়ে ওঠে তার কাছে। যে তীব্রতায় মিশে থাকে মা, মাটি, দেশ, মমতা অনেক কিছু। যা আসলে প্রবাসীদের মতো করে ভেতরে ভেতরে আর কেউ এত গভীর করে লালন করতে পারে না।

পারবেই বা কেমন করে, প্রবাসীরা যে তাদের মায়া ত্যাগ করে অন্য দেশের নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারে না বা অর্জন করলেও তাদের বিবেক তাদের অর্জন করতে দেয় না, সবসময় তাদের ভেতরে ভেতরে বুকের মধ্যে বাজতে থাকে যে, এটা তোমার দেশ না, এটা তোমার দেশ না। তোমার দেশ বাংলাদেশ। তখন প্রবাসীরা নতুন করে সবকিছু দেখতে শুরু করে, যে দেখায় মিশে থাকে দেশের প্রতি গভীর মমতা। এই মমতাই তাদের আবার দেশে ফিরিয়ে আনে, প্রিয় মানুষের কাছে এসে তারা তাদের মুখ দেখে প্রবাসে থাকার তৃষ্ণা দূর করে।

প্রবাসীরা আমাদের দেশের সম্পদ। তারা না থাকলে আমাদের দেশের উন্নতি এতটা চোখে পড়ত না, বাংলাদেশের নামটা অন্যান্য দেশের মতো এত স্পষ্ট করে পরিচিতি পেয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না বা তার কাজ সম্পর্কে, এই দেশ সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা হতো না। প্রবাসীরা হলো একটি দেশের মোহর। দেশ থেকে প্রবাসীরা যখন বিদেশ যায় তখন তাদের প্রতি আমাদের বোধের জায়গাটা আরো খোলসা হওয়া উচিত, যে খোলাসায় থাকবে স্পষ্টতা, গভীরতা, মমতা ও সম্মানবোধ।

প্রবাসীদের ওপর জুলুম করে নানাভাবে ট্রাভেলস এজেন্ট, দালালসহ বিভিন্ন কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটা শ্রেণি। আমাদের পাশের দেশ ভারত নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশের মতো আমাদের ফিক্সড হিসেব রাখার আহ্বান জানান এসব প্রবাসীরা। দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের আরো এগিয়ে আসতে সাহায্য করবে। প্রবাসীরা দেশের সূর্য সন্তান

এমআরএম/পিআর