আন্তর্জাতিক

উ. কোরীয় দুই তরুণীর যৌন দাসত্ব থেকে মুক্তির করুণ গল্প

চীনের ইয়ানজি শহরের আবাসিক এলাকার একটি ভবনের তৃতীয় তলার জানালার সঙ্গে বিছানার চাদর বেঁধে দড়ির মতো তৈরি করেছেন দু’জন নারী। একটু পর দেখা গেল, তারা সেই কাপড় ধরে জানালা থেকে ঝুলে নিচে নেমে আসছেন।

Advertisement

জানালার নিচেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের উদ্ধারকারীরা। তাদের একজন বলছেন, ‘তাড়াতাড়ি, আমাদের বেশি সময় নেই।’ নিরাপদেই তারা দু’জন নিচে নেমে এলেন। এরপর দৌড়ে একটু দূরে অপেক্ষায় থাকা উদ্ধারকারীদের গাড়িতে উঠে পড়লেন। কিন্তু তাদের বিপদ এখনো কাটেনি।

মিরা এবং জিউন দু’জনই উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা নারী; যারা মানব পাচারকারীদের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। যারা তাদের উত্তর কোরিয়া থেকে চোরাচালানের পথ ধরে পালাতে সাহায্য করেছিল, চীনের সীমান্ত অতিক্রমের পর তারাই একটি যৌন ব্যবসা দলের কাছে তাদের হস্তান্তর করে দেয়।

গত পাঁচ বছর ধরে মিরাকে এবং আট বছর আটকে থাকা অবস্থায় যৌন ওয়েব সাইটে মিরাধরে জিউনকে একটি অ্যাপার্টমেন্টে বন্দী করে ওয়েবক্যামের সামনে যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। অনেক সময় ওয়েবক্যামের সামনে তাদের সরাসরি যৌনকর্ম অংশ নিতে বাধ্য করা হতো।

Advertisement

কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া উত্তর কোরিয়া ত্যাগ করা বেআইনি। এখনো দেশ ছাড়তে গিয়ে অনেকে জীবন সংশয়েও পড়েন। দক্ষিণ কোরিয়ায় গেলে নিরাপদ আশ্রয় পাওয়া যায়। কিন্তু উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝের ভূখণ্ডটি সামরিক এলাকা এবং অসংখ্য মাইনে ভরা। ফলে কারো পক্ষে সেখান থেকে পালানো প্রায় অসম্ভব।

দেশ ছাড়তে ইচ্ছুক অনেক উত্তর কোরিয়ান বরং উত্তরের দিকে যায় এবং সেখান থেকে চীনের সীমান্ত অতিক্রম করে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা লোকজনকে অবৈধ অভিবাসী বলে চীনে মনে করা হয় এবং ধরতে পারলে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। এভাবে দেশে ফিরে গেলে এই দেশত্যাগীদের পিতৃভূমির প্রতি বিদ্রোহের অভিযোগে নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাগারে ঠাঁই হয়।

১৯৯০ সালে উত্তর কোরিয়ার চরম দুর্ভিক্ষের সময় অনেক কোরিয়ান তাদের দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন, যাকে বলা হয় আরডুয়োস মার্চ, যখন অন্তত ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু ২০১১ সালে কিম জং-উন ক্ষমতায় আসার পর থেকে উত্তর কোরিয়া থেকে দেশত্যাগী মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ আর দালালদের চাহিদা বেড়ে যাওয়াকে এর কারণ হিসাবে মনে করা হয়।

মিরা যখন দেশ ত্যাগ করেন, তখন তার বয়স ২২ বছর। দুর্ভিক্ষের শেষের দিকে তার জন্ম, যারা উত্তর কোরিয়ার নতুন প্রজন্ম হিসাবে বেড়ে উঠেছে। যারা আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটের বদৌলতে ডিভিডি, কসমেটিকস, কাপড়চোপড় আর পাইরেটেডে বিদেশি চলচ্চিত্র দেখতে পারে।

Advertisement

বহির্বিশ্বের এসব জিনিস তাদের দেশ ত্যাগ করতে আগ্রহী করে তোলে। পাইরেডেট যেসব চলচ্চিত্র তারা দেখতে পায়, সেখানে বহির্বিশ্বের একটি খণ্ডিত চিত্র তাদের চোখে ধরা পড়ে; যা তাদের দেশ ত্যাগ করতে উৎসাহ যোগায়।

ফলে যারা উত্তর কোরিয়া ত্যাগ করে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, মিরা তাদেরই একজন। ‘আমি চীনা চলচ্চিত্রগুলো বুদ হয়ে গিয়েছিলাম এবং ভাবতে শুরু করেছিলাম যে, চীনের সব মানুষই হয়তো এরকম। আমি একজন চীনা যুবককে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম এবং উত্তর কোরিয়াতে এরকম একজনকে অনেকদিন ধরে খুঁজেছি’- বলছেন মিরা।

তারা পিতা, সাবেক সৈনিক এবং পার্টির একজন সদস্য ছিলেন খুবই কড়া একজন ব্যক্তি, যিনি পরিবারকে শক্ত হাতে পরিচালনা করতেন। কখনো কখনো তিনি মিরাকে মারধরও করতেন। একজন চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন মিরা, কিন্তু তার পিতা তাতে বাধা দেন। ফলে সে আরো বেশি হতাশ হয়ে পড়ে এবং চীনে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

‘আমার বাবা ছিলেন পার্টির একজন সদস্য এবং এটা ছিল দম বন্ধ করা একটি ব্যাপার। তিনি আমাদের বিদেশি চলচ্চিত্র দেখতে দিতেন না, আমাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠতে হতো এবং ঘুমাতে যেতে হতো। আমার নিজস্ব কোন জীবন ছিল না।’

অনেক বছর ধরে মিরা একজন দালালকে খোঁজেন যিনি তাদের টুমেন নদী পার হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে সহায়তা করবেন। কিন্তু সরকারের সঙ্গে তার পরিবারের সম্পর্ক চোরাকারবারিদের নার্ভাস করে তোলে যে, মিরা হয়তো তাদের সম্পর্কে সরকারকে জানিয়ে দেবে।

চার বছর ধরে চেষ্টার পরে অবশেষে তিনি এমন একজনে খুঁজে পেলেন, যিনি তাকে সীমান্ত পার হতে সহায়তা করবেন।

অন্য অনেক দেশত্যাগীর মতো পাচারকারীদের দেয়ার জন্য মিরারও পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না। সুতরাং সে ‘বিক্রি’ হতে রাজি হয়, যার ফলে কাজ করে সে তার দেনা শোধ করবে। মিরা ভেবেছিল, তাকে কাজ করতে হবে কোন রেস্তোরাঁয়।

কিন্তু সে আসলে প্রতারণার শিকার হয়। মিরা এমন একটি পাচারকারী গ্রুপের শিকারে পরিণত হয়, যারা উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা নারীদের যৌন ব্যবসায় বাধ্য করে থাকে।

টুমেন নদী পার হয়ে চীনে প্রবেশের পর মিরাকে সরাসরি ইয়ানজি শহরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তাকে একজন কোরিয়ান-চীনা ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই ব্যক্তিকে এরপর থেকে সে ‘পরিচালক’ হিসাবেই চিনবে।

ইয়ানবিয়ান অঞ্চলের কেন্দ্র স্থলে ইয়ানজি শহরটি অবস্থিত। আদি কোরিয়ান অধ্যুষিত এলাকাটি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র, যেখানে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা অনেকেই লুকিয়ে থাকেন।

পলাতকদের বড় একটি অংশই নারী। কিন্তু চীনে তাদের বসবাসের কোন আইনি মর্যাদা না থাকায় এই নারীরা সহজ শিকারে পরিণত হয়। অনেকে গ্রামীণ এলাকাগুলোয় কনে হিসাবে বিক্রি হয়, অনেকে যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হয়, আর মিরার মতো অনেকে ক্যামেরার সামনে যৌনতা সংশ্লিষ্ট কাজ করতে বাধ্য হয়।

অ্যাপার্টমেন্টে আসার পর ওই পরিচালক মিরার কাছে অবশেষে ব্যাখ্যা করে বলেন যে, তার চাকরিটা আসলে কী? মিরার জন্য একজন প্রশিক্ষক ঠিক করে দেন তিনি, যে তার সঙ্গে একই রুমে থাকবে। মিরাকে চোখে চোখে রাখবে, শেখাবে এবং অভ্যাস করাবে।

‘আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অনেক মানুষের সামনে সব পোশাক খুলে ফেলা, একজন নারী হিসাবে এটা খুবই অপমানজনক ছিল। আমি কান্নায় ভেঙে পড়লে তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার দেশের কথা মনে পড়ছে কিনা!’

ওই যৌন ওয়েবসাইট এবং এর বেশিরভাগ গ্রাহকই দক্ষিণ কোরিয়ান। তারা প্রতি মিনিটের জন্য টাকা দিতো, সুতরাং নারীদের উৎসাহ দেয়া হতো তারা যেন যত বেশি সম্ভব গ্রাহকদের ওয়েবসাইটে ধরে রাখে। যখনই মিরা আর এই কাজ করতে চাইতো না, ওই পরিচালক তাকে উত্তর কোরিয়া ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিতেন।

‘আমার পরিবারের সব সদস্য সরকারে কাজ করে। আমি সেখানে ফিরে গেলে তাদের সবার লজ্জার কারণ হবো। তার চেয়ে আমার নিখোঁজ হয়ে যাওয়া বা মরে যাওয়া ভালো’- বলছেন মিরা।

একই সময়ে ওই অ্যাপার্টমেন্টে ৯ জন পর্যন্ত নারী থাকতেন। যখন মিরার প্রথম রুমমেট আরেকটি মেয়ের সঙ্গে মিলে পালিয়ে যায়, তখন মিরাকে আরেকটি গ্রুপের সঙ্গে থাকতে দেয়া হয়। সেখানেই তার প্রথম জিউনের সঙ্গে পরিচয় হয়।

২০১০ সালে যখন উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসে, তখন জিউনের বয়স মাত্র ১৬ বছর। তার দুই বছর বয়সের সময় তার বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় এবং তাদের পরিবার চরম দারিদ্রের মধ্যে পড়ে। ১১ বছর বয়সে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, যাতে সে কাজ করতে পারে। বাড়তি কিছু অর্থ আয়ের উদ্দেশ্যে অবশেষে তার পরিবার চীনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

কিন্তু মিরার মতো সেও দালালদের খপ্পরে পড়ে। যখন সে ইয়ানজি শহরে আসে, ‘পরিচালক’ তাকে পুনরায় উত্তর কোরিয়া পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। কারণ সে বলে, ‘জিউন খুব কালো আর অসুন্দর।’

কিন্তু পরিস্থিতি যাই হোক, জিউন আর সেখানে ফিরে যেতে রাজি ছিল না। ‘এটা এমন একটি কাজ, যেটা আমি সবচেয়ে অপছন্দ করি। কিন্তু চীনে আসার জন্য আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি, সুতরাং আমি খালি হাতে ফেরত যেতে পারি না’- বলছেন জিউন।

‘আমার স্বপ্ন ছিল পৃথিবী ছাড়ার আগে আমার দাদা-দাদীকে খানিকটা ভাত খাওয়ানো, যার জন্য আমি সবকিছুই করতে পারি। আমি পরিবারের কাছে কিছু টাকা পাঠাতে চেয়েছিলাম।’

জিউন খুব কঠোর পরিশ্রম করে। তার আশা ছিল, পরিচালক হয়তো তার কর্মনিষ্ঠার জন্য তাকে পুরস্কৃত করবে। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে আর তাদের কাছে টাকা পাঠাতে পারবে, এই প্রতিশ্রুতিকে সে এমনভাবে কাজ করতে থাকে যার ফলে সেখানকার অন্য মেয়েদের চেয়েও সে বেশি অর্থ আনতে শুরু করে।

‘আমি চেয়েছিলাম যে পরিচালক আমার গুরুত্ব বুঝতে পারুক এবং আমি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, ভালো করতে পারলে এই বাড়ি থেকে মুক্তি পাওয়া প্রথম মেয়েটি হবো আমি।’

অনেক সময় রাতে সে মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমিয়েছে, যাতে সে প্রতিদিনের লক্ষ্য ১৭৭ ডলার আয় করতে পারে। পরিবারের জন্য অর্থ আয় করতে সে অনেকটা মরিয়া হয়ে ছিল। এ সময় জিউন মিরাকেও পরামর্শ দিয়েছিল যেন সে বিদ্রোহী হয়ে না ওঠে এবং পরিচালকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রক্ষা করে।

মিরাকে সে পরামর্শ দিয়েছিল, প্রথমত, কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। পরিচালক যদি তোমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে না থাকে, তাহলে তার সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করতে পারো। জিউন বলছে, ওই বছরগুলোতে অন্য মেয়েদের চেয়ে সে অনেক বেশি অর্থ আয় করেছে।

‘আমি ভেবেছিলাম পরিচালক সত্যিই আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু যেদিন আমার আয় কমে গেল, তার চেহারার অভিব্যক্তিও বদলে গেলো। সে হয়তো আমাদের বলতে পারতো যে, এত কষ্ট করো না।

ওই অ্যাপার্টমেন্টটি পরিচালকের পরিবারের সদস্যরা কড়াভাবে পাহারা দিতো। তারা পিতা-মাতা সামনের কক্ষে ঘুমাতো এবং সামনের দরজাটি সবসময়েই বন্ধ থাকতো। পরিচালক নিজেই মেয়েদের খাবার পৌঁছে দিতো এবং তার ভাই প্রতিদিন সকালে এসে আবর্জনা নিয়ে যেতো।

‘এটা ছিল পুরোপুরি একটি কারাগার, বরং তার চেয়েও খারাপ’- বলছেন জিউন।

প্রতি ছয়মাসে একবার বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেতো উত্তর কোরিয়ার মেয়েরা। তবে আয় অনেক বেশি হলে মাসে একবার এই সুযোগ মিলতো। এ সময় তারা কেনাকাটা করতো অথবা চুলের পার্লারে যেতো। কিন্তু তখনো তাদের অন্য কারো সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হতো না।

‘একজন প্রেমিকের মতো আমাদের পাশাপাশি হাঁটতেন পরিচালক, কারণ তিনি ভয় পেতেন যে, আমরা হয়তো পালিয়ে যাবো’- বলছেন মিরা। ‘আমি আশপাশে হেটে দেখতে চাইতাম, কিন্তু সেটা কখনো করতে দেয়া হতো না। কারো সঙ্গে আমাদের কথা বলতে দেয়া হতো না, এমনকি পানির একটি বোতল কেনার সময়ও না। নিজেকে আমার বোকা বোকা মনে হতো।’

একজন উত্তর কোরীয় নারীকে অ্যাপার্টমেন্টে ‘ব্যবস্থাপক’ হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন পরিচালক। যখন পরিচালক থাকতেন না, তার পক্ষে অন্য মেয়েদের ওপর তিনি নজরদারি করতেন। মিরাকে ওই পরিচালক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ভালোভাবে কাজ করলে একজন ভালো মানুষের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দেবেন। জিউনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তাকে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন।

যখন জিউন তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করে, তখন তাকে বলা হয়, তার যাতায়াতের জন্য ৫৩ হাজার ২০০ ডলার দিতে হবে। পরে তিনি বলেন, তিনি জিউনকে মুক্তি দিতে পারছেন না, কারণ কোন দালালকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ওয়েবক্যামের সামনে যৌনতার কাজ করার পর যে অর্থ উপার্জন হয়, তার কোন কিছুই কখনো পাননি মিরা বা জিউন। প্রথমে পরিচালক রাজি হয়েছিল যে, মোট আয়ের ৩০ শতাংশ তাদের দেয়া হবে। যখন তারা চলে যাবে, তখন এই অর্থ তারা পাবে।

কিন্তু মিরা এবং জিউন ক্রমেই বুঝতে শুরু করেছিল যে, তারা হয়তো কোনদিনই মুক্তি পাবে না। জিউন বলছেন, ‘এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণত আমরা যা ভাবি, আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়। কিন্তু আমি একবার অতিরিক্ত ওষুধ খেয়েছিলাম আর আরেকবার জানালা থেকে ঝাপ দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম।’

এর মধ্যেই মিরার পাঁচটি বছর আর জিউনের সাতটি বছর চলে গেছে। এরপর তিন বছর ধরে চেনা মিরার ওয়েবক্যামের একজন গ্রাহকের তার প্রতি মায়া হয়। তিনি মিরাকে প্যাস্টর চুয়ান কিওয়ানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি গত ২০ বছর ধরে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা মানুষজনকে সহায়তা করছেন।

ওই গ্রাহক দূর থেকে মিরার কম্পিউটারে একটি বার্তা পাঠানোর অ্যাপলিকেশন স্থাপন করে দেন, যা দিয়ে মিরা প্যাস্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা মানুষজনের মধ্যে প্যাস্টর চুয়ান কিওয়ান ভালো পরিচিত। দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রায়ই তাকে আক্রমণ করে ‘অপহরণকারী’ বলে বর্ণনা করে।

১৯৯৯ সালে ক্রিশ্চিয়ান দাতব্য প্রতিষ্ঠান ডুরিহানা প্রতিষ্ঠান পর থেকে তিনি প্রায় ১২০০ দেশত্যাগীকে নিরাপত্তায় সহায়তা করেছেন। তিনি প্রতিমাসেই দুই অথবা তিনটি উদ্ধার অভিযানের অনুরোধ পান। তবে মিরা আর জিউনের ঘটনাটি তাকে খুবই আহত করে।

প্যাস্টর চুয়ান কিওয়ান বলছেন, ‘আমি অনেক মেয়েকে দেখতে পেয়েছি যারা তিনবছর ধরে কারাগারে আছে। কিন্তু এতবছর ধরে এভাবে আটকে রাখার ঘটনা আর আমি দেখিনি। এটা আমার হৃদয় ভেঙ্গে দিয়েছিল।’ তিনি বলছেন, নারীদের পাচারকারী চক্রটি অনেক বেশি সংঘবদ্ধ এবং সীমান্তে পাহারা দেয়া কিছু উত্তর কোরীয় সেনাও এর সাথে জড়িত।

চীনের সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয়দের ভাষায়, নারীদের পাচারকে ‘কোরিয়ান শুকরের ব্যবসা’ বলে বর্ণনা করা হয়। পাচার করা নারীদের দাম ১০০ ডলার থেকে শুরু করে হাজার ডলার হতে পারে। যদিও সরকারি পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন, তবে ব্যাপকহারে উত্তর কোরিয়ার নারীদের পাচারের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মানব পাচারের ওপর বাৎসরিক প্রতিবেদনে উত্তর কোরিয়াকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট দেশগুলোর একটি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পরবর্তী কয়েক মাস ধরে মিরা এবং জিউনের সঙ্গে একজন গ্রাহক সেজে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন চোয়ান।

তিনি বলছেন, ‘সাধারণত আটকে রাখা নারীরা বুঝতে পারে না তারা কোথায় আছে, কারণ এসব অ্যাপার্টমেন্টে হয়তো রাতের বেলা বা চোখ বন্ধ করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। ভাগ্যক্রমে মিরা এবং জিউন জানতো যে তারা ইয়ানজিতে রয়েছে এবং তারা বাইরে একটি হোটেলের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছিল।’

গুগল ম্যাপ থেকে তাদের ঠিকানা বের করে ওই অ্যাপার্টমেন্টটি আগে থেকে ভালো মতো দেখার জন্য একজন স্বেচ্ছাসেবীকে পাঠান চোয়ান। দেশত্যাগী যেকারো জন্যই চীন থেকে বেরিয়ে যাওয়া বিপদজনক হতে পারে।

বেশিরভাগই তৃতীয় একটি দেশে যেতে চান অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসে। যেখান থেকে তারা বিমানে করে দক্ষিণ কোরিয়ায় যেতে পারবেন এবং আশ্রয় চাইতে পারবেন। তবে কোন পরিচয়পত্র ছাড়া চীনের ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করা তাদের জন্য বিপজ্জনক।

‘অতীতে দেশত্যাগী মানুষজন ভুয়া পরিচয়পত্র দিয়ে চলে যেতে পারতো। কিন্তু এখন কর্মকর্তারা এমন যন্ত্র ব্যবহার করেন, যা দিয়ে বোঝা যায় যে, পরিচয়পত্রটি আসল নাকি নকল’- বলছেন চোয়ান। ওই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পালানোর পর জিউন এবং মিরা চীনের ভেতর দিয়ে ডুরিহানার স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করেন।

পরিচয়পত্র না থাকার কারণে তারা কোন হোটেলে উঠতে পারেননি। ফলে তাদের ট্রেনে ঘুমানো অথবা রেস্তোরাঁয় জেগে বসে থেকে রাত পার করতে হয়েছে।

চীনের শেষের দিনে পাঁচ ঘণ্টা ধরে একটি পাহাড় বেয়ে ওঠার পর তারা সীমান্ত অতিক্রম করে প্রতিবেশী একটি দেশে প্রবেশ করে। যে পথ ধরে তারা সেখানে গিয়েছে, তা প্রকাশে বাধা রয়েছে। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে পালানোর ১২ দিন পর মিরা এবং জিউনের সঙ্গে প্রথমবারের মতো চোয়ানের দেখা হয়।

‘আমি ভেবেছিলাম, আমি তখনই নিরাপদ বোধ করবো যখন আমি দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকত্ব পাবো। কিন্তু প্যাস্টর চোয়ানের সঙ্গে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি নিরাপদ বোধ করতে শুরু করলাম। আমি মুক্তি পাওয়ার আনন্দে কাঁদতে শুরু করলাম’- বলছেন জিউন।

পরের ২৭ ঘণ্টা ধরে তারা একটি গাড়িতে করে একসঙ্গে কাছের দক্ষিণ কোরিয়ার দূতাবাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। চোয়ান বলছেন, অনেক উত্তর কোরিয়ানের জন্য যাত্রার শেষের অংশটি কঠিন হয়ে যায়, যেহেতু সেটি গাড়িতে করে যেতে হয়, যা অনেকেরই সামর্থ্যের বাইরে।

‘দেশত্যাগীরা অনেক সময় গাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়ে, বমি করেন। এটা নরকের মতো একটি রাস্তা, যা স্বর্গের দিকে নিয়ে যায়’- বলছেন চোয়ান। দূতাবাসে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে মিরা দুর্বলভাবে হাসেন এবং বলেন, তার কান্না আসছে।

‘আমার মনে হচ্ছিল, আমি সব দুঃখ দুর্দশা কাটিয়ে উঠলাম। অনেক অনুভূতি আসা-যাওয়া করলো। দক্ষিণ কোরিয়া গেলে আমি হয়তো কখনোই আমার পরিবারের সদস্যদের দেখতে পাবো না, সেজন্য আমার অপরাধ বোধও লাগছিল। আমার দেশত্যাগের উদ্দেশ্য এটা ছিল না’- বলছেন জিউন।

প্যাস্টর চোয়ান এবং দুই তরুণী একসঙ্গে দূতাবাসে প্রবেশ করেন। কয়েক সেকেন্ড পর চোয়ান ফিরে যান, তার কাজ শেষ হয়ে গেছে। মিরা এবং জিউনকে সরাসরি দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় দু’জনকে, যাতে তারা নিশ্চিত হতে পারে যে তারা গুপ্তচর নয়।

এরপর তাদের পরবর্তী তিন মাস কাটাতে হবে উত্তর কোরিয়ানদের জন্য নির্ধারিত হানাউইন পুনর্বাসন কেন্দ্রে, যেখানে তারা দক্ষিণ কোরিয়ার জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার প্রশিক্ষণ পাবেন।

দেশত্যাগীরা শিখবেন কিভাবে বাজারহাট করতে হয়, কিভাবে স্মার্ট ফোন চালাতে হয়, মুক্তবাজার অর্থনীতি আর চাকরির প্রশিক্ষণ পাবেন। তাদের নিয়মিত কাউন্সেলিং দেয়া হবে। এরপর তারা দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক হয়ে উঠবেন।

‘আমি ইংরেজি অথবা চাইনিজ শিখতে চাই, যাতে আমি একজন ভ্রমণ গাইড হতে পারি’- বলছেন মিরা।

‘কফি শপে কফি খেয়ে আর বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে আমি একটি স্বাভাবিক জীবন কাটাতে চাই। কেউ একজন আমাকে বলেছিল, একদিন বৃষ্টি ঠিকই থামবে, কিন্তু আমার জন্য বর্ষাকাল এতদিন ধরে চলেছে যে, আমি সূর্যের কথা ভুলেই গেছি।’ বিবিসি বাংলা।

এসআইএস/এমএস