পৃথিবীর প্রথম মানুষ হিসেবে প্রায় ৫০ বছর আগে নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রাখেন। এরপর তার বিখ্যাত বক্তব্যটি ছিল, ‘মানুষের এই ক্ষুদ্র পদক্ষেপটি মানব সভ্যতাকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেল।’ তার কিছুক্ষণ পরেই তার সহকর্মী বায অলড্রিন (যার আসল নাম এডউইন অলড্রিন জুনিয়র) তার সঙ্গে যোগ দেন। ঈগল চন্দ্রযান থেকে বেরিয়ে অলড্রিন চাঁদের বিস্তীর্ণ সৌন্দর্য দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘অভাবনীয় নির্জনতা’।
Advertisement
১৯৬৯ সালের জুলাই মাসের অ্যাপোলো-১১ অভিযানের পর চাঁদ বেশিরভাগ সময় স্পর্শহীন থেকেছে। ১৯৭২ সালের পর থেকে সেখানে আর কোনো মানুষের পা পড়েনি। তবে এটি হয়তো খুব তাড়াতাড়ি পাল্টে যাচ্ছে, কারণ অনেকগুলো কোম্পানি চাঁদের অভিযানের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের অনেকে সম্ভবত চাঁদে খনি অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে স্বর্ণ, প্লাটিনাম আর দুর্লভ সব ধাতু আহরণ করতে চাইবে, যেগুলো বৈদ্যুতিক যন্ত্রে ব্যবহার করা যায়।
এ মাসের শুরুর দিকে ‘চাঙ্গ এ ফোর’ নামে চীনের একটি নভোযান চাঁদের অপর পিঠে নেমেছে। চন্দ্রপৃষ্ঠে একটি জীবমণ্ডল স্থাপন করে সেখানে একটি চারা গাছ রোপণ করতে সক্ষম হয় ওই চন্দ্রযানটি। এখন সেখানে একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করার চেষ্টা করছে ওই চন্দ্রযান।
জাপানের কোম্পানি আইস্পেস ‘চাঁদ-পৃথিবী পরিবহন প্ল্যাটফর্ম’ নামের একটি পরিকল্পনা নিয়েছে, যার মাধ্যমে তারা চাঁদের মেরুতে অভিযান চালাতে চায়। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, অলড্রিনের চাঁদের সেই অভাবনীয় নির্জনতা কি টিকে থাকবে নাকি পৃথিবীর এই একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহটি বাণিজ্যিক আর রাজনৈতিক জমি ও সম্পদ দখলের লড়াইয়ে পরিণত হবে?
Advertisement
স্নায়ুযুদ্ধের সময় মহাকাশ অভিযান শুরুর পরপরই মহাকাশের নানা বস্তুর মালিকানার বিষয়টি একটি ইস্যু হয়ে ওঠে। যখন নাসা তাদের প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশযান চাঁদে পাঠানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তখন জাতিসংঘে বহির্জগতের মহাকাশ চুক্তি নামের একটি চুক্তিপত্র গ্রহণ করা হয়। ১৯৬৭ সালের ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য। সেখানে বলা হয়, পৃথিবীর বাইরের মহাশূন্যে, চাঁদ এবং অন্যান্য যেসব বস্তু রয়েছে, সেখানে কোনো দেশ দখল বা অন্য কোনোভাবে নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করতে পারবে না।
মহাকাশবিষয়ক কোম্পানি অলডেন অ্যাডভাইজারর্সের পরিচালক জোয়ানা হোয়েলার বলছেন, ওই চুক্তিটি হচ্ছে মহাকাশের ম্যাগনা কার্টার মতো। এর ফলে আর্মস্টং এবং অন্যরা চাঁদে যে পতাকা পুতে রেখে এসেছিলেন, সেটি অর্থহীন হয়ে পড়ে, যেহেতু চাঁদে কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা দেশের মালিকানা নাকচ হয়ে গেছে।
চাঁদের বুকে পৃথিবীর দ্বিতীয় মানব বুয অলড্রিনসত্যি কথা বলতে, ১৯৬৯ সালে চাঁদে জমির মালিকানা বা খনির অধিকার তেমন একটা গুরুত্বও বহন করতো না। কিন্তু যেহেতু প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে, খনি আহরণ এখন খুবই লাভজনক একটি ব্যাপার। সুতরাং বহুদূর থেকেও খনি আহরণ করাটা লাভজনক হলে সেটি অনেকের কাছেই আকর্ষণীয় হতে পারে।
১৯৭৯ সালে চাঁদ ও মহাশূন্যের অন্যান্য বস্তুতে বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলোর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সমঝোতা প্রস্তাব আনে জাতিসংঘ, যেটি ‘মুন এগ্রিমেন্ট’ নামে বেশি পরিচিত। সেখানে মূল বিষয়গুলো ছিল, এসব কর্মকাণ্ড হতে হবে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে এবং কোনো মহাকাশ স্টেশন বানাতে হলে আগে জাতিসংঘকে অবশ্যই জানাতে হবে কেন এবং কোথায় তারা সেটি বানাতে চায়।
Advertisement
ওই চুক্তিতে আরো বলা হয়েছিল, চাঁদ এবং এর সকল প্রাকৃতিক সম্পত্তি মানব সভ্যতার সকলের সমান অধিকার থাকবে। যখন সেখান থেকে খনি আহরণ সম্ভব হবে, তখন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে, যারা সেই আহরণের বিষয়গুলো দেখভাল করবে।
তবে ওই চুক্তিটির সমস্যা হলো, মাত্র ১১টি দেশ সেটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স ও ভারত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন এবং রাশিয়ার মতো মহাকাশ গবেষণার প্রধান দেশগুলো চুক্তিটি সমর্থন করেনি।
মিজ হোয়েলার বলছেন, কোনো চুক্তিতে উল্লেখ করা আইনগুলোর প্রয়োগ করা ততটা সহজ নয়। কারণ এসব চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোকে সেটিকে তাদের আইনে পরিণত করতে হবে এবং কোম্পানি বা ব্যক্তিদের সেটা মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে।
চাঁদে পাওয়া যেতে পারে পানি-স্বর্ণ-প্লাটিনাম-দুর্লভ ধাতু‘জার্নাল অব স্পেস ল’ এর সাবেক প্রধান সম্পাদক জোয়ান্নে ইরিনে গ্রাব্রিনোভিচ বলছেন, আসলে আন্তর্জাতিক সমঝোতা বাস্তবে কোনো নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ সেটি বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতি, অর্থনীতি এবং গণ মতামতের ওপর নির্ভর করে। তার মতে, মহাশূন্যের গ্রহ-উপগ্রহের ওপর মালিকানা না থাকার বর্তমান চুক্তিগুলো সাম্প্রতিক সময়ে আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র মহাশূন্যে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ রেখে একটি আইন অনুমোদন করে। সেখানে বলা হয়, কোনো গ্রহাণু থেকে নাগরিকদের খনি সম্পদ আহরণের অধিকার দেয়া হয়। সেখানে চাঁদের কথা উল্লেখ করা হয়নি, তবে একসময় সেটিও এই আইনের আওতায় চলে আসতে পারে। খনি সন্ধানী কোম্পানি প্লানেটারি রিসোর্সেসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এরিক অ্যান্ডারসন এই আইনকে বিশ্ব ইতিহাসের সম্পত্তি মালিকার সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি বলে বর্ণনা করেছেন।
২০১৭ সালে লুক্সেমবার্গ তাদের নিজস্ব আইন অনুমোদন করে যেখানে মহাশূন্যে অধিকার করা কোনো বস্তু বা সম্পত্তির মালিকানার স্বীকৃতি দেয়া হয়। এর ফলে এই খাতে দেশটি শীর্ষ অবস্থানে থাকবে বলে আশা করছেন সেদেশের নেতারা।
মহাকাশে অভিযান এবং আরো বেশি অর্থ লাভের সম্ভাবনায় কোম্পানিগুলোকে সহায়তা করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে অনেক দেশ। ‘নালেডি স্পেস ল অ্যান্ড পলিসি’র আইনজীবী হেলেন তাবেনি বলছেন, চাঁদের কোনোরকম ক্ষতি না করে খনি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেখানকার সম্পদ পৃথিবীতে নিয়ে আসা বা চাঁদে মজুদ করে রাখা সম্ভব নয়।
তিনি বলছেন, বরং এই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং লুক্সেমবার্গ মহাকাশের চুক্তিগুলোকে দুমড়ে নিজেদের স্বার্থের পথ দেখছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যদি এভাবে একসঙ্গে মহাকাশে সম্পদ আহরণের মতো কর্মকাণ্ড শুরু করে, তাহলে প্রকৃতি কতটা সুরক্ষিত থাকবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসআর/জেআইএম