টি-টোয়েন্টি মানেই হলো খুব সহজ একটি ম্যাচ। যেখানে এক দলের জয় মানেই হলো অন্য দলকে প্রায় উড়িয়ে দেয়া। কিন্তু ২০১৮ আইপিএলে দারুণ একটি বিষয় ঘটেছে। ভারতীয় ফ্রাঞ্চাইজি লিগটির সর্বশেষ আসরে সবচেয়ে দ্রুত রান তোলার দিকে শীর্ষে ছিল দিল্লি ডেয়ারডেভিলস। কিন্তু গ্রুপ পর্বে পয়েন্ট টেবিলের সর্বশেষ দলটির নাম ছিল দিল্লি। আর গ্রুপ পর্বে সবচেয়ে মন্থরগতির রান তোলা দলটির নাম ছিল সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। অথচ তারাই খেলেছিল টুর্নামেন্টের ফাইনাল।
Advertisement
ফুটবল ট্যাকটিস নিয়ে গবেষণা করেন এমন একজন ইউরোপিয়ান বিখ্যাত লেখক জোনাথান উইলসন গত বছর হোসে মরিনহো এবং পেপ গার্দিওলার কোচিংয়ের স্টাইলের পার্থক্য তুলে ধরতে গিয়ে অবতারণা করেছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আবির্ভাবের ১৫ বছর পরও, যখন এই ফরম্যাটটা ক্রিকেট বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তখনও কোনো দলই এই ফরম্যাটের কোনো ধারণাগত কিংবা চিন্তাগত কোনো সঠিক স্টাইল দাঁড় করাতে পারেনি।
অথচ ফুটবল, বাস্কেটবল কিংবা অন্য খেলাগুলোকে যখন গবেষণা করা যায়, তখন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট নিয়ে সত্যিই প্রথাগত কোনো গবেষণা করা খুবই দুরূহ। প্রথমেই উল্লিখিত আইপিএলের ঘটনা থেকে সেটাই প্রমাণিত হয়। কোনো দল ভালো, খেলে ভালো এবং দিন শেষে তারাই সাফল্যের মুকুট পরবে, টি-টোয়েন্টি এই প্রথাগত ধারণার মিল খুবই কম।
তবে, প্রথাগত ধারণা থাকুক বা না থাকুক- টি-টোয়েন্টিতে একটি দল গড়ে উঠে মূলতঃ হার্ডহিটার ব্যাটসম্যানকে কেন্দ্র করেই। জাতীয় দলগুলোর চেয়ে ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টিতে তো এই ধারণাটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে গেছে। প্রতিটি দলই তাদের মূল চিন্তা-ধারা এবং পরিকল্পনায় টি-টোয়েন্টির ‘ছক্কাড়ু’ ব্যাটসম্যানদেরই সবচেয়ে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বিশেষ করে যেসব ব্যাটসম্যান প্রায় প্রতি বলেই ছক্কা মারতে পারে কিংবা হিট করতে পারে- তারাই মূল্যায়ন পান সবচেয়ে বেশি।
Advertisement
ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে টাকার ঝনঝনানি তো পাওয়ার হিটারদের নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। বিভিন্ন দেশের ফ্রাঞ্চাইজি লিগগুলোতে এমনিতেই উচ্চমাত্রার পারিশ্রমিক এবং একই সঙ্গে বিদেশি ক্রিকেটারদের নির্ধারিত কোটা- যে কারণে ‘ছক্কাড়ু’ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে যারা অগ্রগণ্য, তাদের চাহিদা আকাশচুম্বী। ‘এ কারণে ফ্রাঞ্চাইজিগুলোও দল তৈরি করার সময় খুব হিসেব-নিকেশ করে নিজেদেরকে তৈরি করে নেয়। এমনকি বিদেশি লিগে কিংবা অন্য কোনো কন্ডিশনে খেলতে গেলেও কোচ এবং অধিনায়কের চিন্তায় খেলার স্টাইলে কোনো পরিবর্তন আসে না’- বলছিলেন ২০০৯ সালে কলকাতা নাইট রাইডার্সের অ্যানলিস্ট এ আর শ্রীকান্ত।
ক্রিকেট বিশ্বে ‘ছক্কাড়ু’ ব্যাটসম্যানদের কদর বাড়ার কারণেই ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের। প্রায় প্রতিটি লিগেই তাদের সরব উপস্থিতি ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে আলাদা আবেদন তৈরি করে নিয়েছে। এ কারণে ফ্রাঞ্চাইজিগুলোর প্রায় প্রতিটি দলই একের অধিক ক্যারিবীয় ক্রিকেটার নিজেদের দলে রাখতে চান।
৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ক্যারিবীয় ‘ছক্কাড়ু’দের নিয়ে একটি একাদশ তৈরির চেষ্টা করা হয়। যেখানে দেখা গেছে সেই একাদশে থাকা ‘ছক্কাড়ু’দের মারা মোট ছক্কার সংখ্যা ২৬৩০টি। কল্পনা করা যায়! প্রায় প্রতি ১২ বলে একটি করে ছক্কা হাঁকিয়েছেন ক্যারিবীয় সেই একাদশের ব্যাটসম্যানরা।
Advertisement
নিঃসন্দেহে ছক্কা মারার দিক থেকে এগিয়ে ক্যারিবীয় ব্যাটিং দানব ক্রিস গেইল। ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত পাওয়া হিসেবে দেখা যাচ্ছে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে মোট ৮৯২টি ছক্কার মার মেরেছেন তিনি। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে এখনও পর্যন্ত (২১ জানুয়ারি) গেইলের নামের পাশে শোভা পাচ্ছে ৩৬২ ম্যাচে ১২ হাজার ১৩৪ রান। ছক্কা ৮৯৫টি (২১ জানুয়ারি পর্যন্ত)। বাউন্ডারির সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি, ৯২৮টি। সর্বোচ্চ স্কোর অপরাজিত ১৭৫। সেঞ্চুরি ২১টি এবং হাফ সেঞ্চুরি ৭৫টি।
এটা তো কেবল ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টিতে এবং একমাত্র তিনি এই ফরম্যাটে ১০ হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রমকারী ব্যাটসম্যান। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে গেইল ৫৬ ম্যাচ খেলে করেছেন ১৬০৭ রান। ছক্কার মার ১০৩টি। ১৩৭টি বাউন্ডারি, সেঞ্চুরি ২টি এবং হাফ সেঞ্চুরি ১৩টি।
ক্যারিবীয় ‘ছক্কাড়ু’দের নিয়ে গড়া একাদশের ছক্কার সংখ্যা দেখুন ছবি সারণীতে। এখানকার হিসেবগুলো কেবল ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের। ‘ছক্কাড়ু’তে এগিয়ে নিঃসন্দেহে ক্যারিবীয়রা। পিছিয়ে নেই অন্য অনেক দেশের ব্যাটসম্যান। যেমন এবি ডি ভিলিয়ার্স।
দক্ষিণ আফ্রিকার এই ব্যাটসম্যান প্রায় প্রতিটি বলেই স্কোর করতে পারে। এমনকি অনায়াসেই বলটাকে বাতাসে ভাসিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারে বাউন্ডারির অন্য পাশে। টি-টোয়েন্টিতে ডি ভিলিয়ার্সের মতো ব্যাটসম্যানদের প্রায় সবারই একটা মানসিকতা একেবারে প্রায় সমান। সেটা হচ্ছে যত বেশি পারা যায় ছক্কা মারতে হবে এবং প্রতিটি বলেই রান করতে হবে।
ক্রিস গেইল এবং বিরাট কোহলি হলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। গেইলের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। প্রতি ম্যাচেই ২.৫টি করে ছক্কা হাঁকিয়েছেন তিনি। কিন্তু গেইলের ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় হচ্ছে, যতটা না ছক্কা হাঁকান তিনি, তার চেয়েও বেশি ডট বল খেলেন। ২০১৭ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত যত বল খেলেছেন তার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি ডট বল খেলেছেন তিনি। একই সঙ্গে শুরুটা তার খুবই স্লো। প্রথম ১০ বলে আসে ১টি কিংবা ২টি রান। এরপরই হাত খোলে গেইলের।
বিরাট কোহলিও সামনতালে ছক্কা হাঁকাতে পারেন। তবে ছক্কার চেয়ে তিনি বলকে মাটিতে রাখতেই বেশি পছন্দ করেন। যে কারণে দেখা যাচ্ছে ছক্কার চেয়ে বাউন্ডারির সংখ্যা প্রায় তিনগুণ (ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে) বেশি কোহলির। ২৪৫ ছক্কার বিপরীতে বাউন্ডারি ৭২২টি। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে পরিমাণটা আরও খারাপ। ৪৮ ছক্কার বিপরীতে ২১৮টি বাউন্ডারি।
প্রতিটি দলই একই নীতিতে চলতে চায়। হিট করো, ছক্কা মারো, প্রতি বলেই রান করো। তবে গেইলের অ্যাপ্রোচ কেউ অনুসরণ করতে চায় না। কারণ, ওই যে ডট বল! অথচ, গেইল ২০১২ এবং ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ইনিংস ওপেন করেছেন এবং দুই আসরেই শিরোপা জিতেছে ক্যারিবীয়রা। মাঝে ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ উঠেছিল সেমিফাইনালে।
প্রতিবলে ছক্কা মারার চেয়ে ক্যারিবীয়রা খেলার মাঝে প্রজ্ঞাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কার্যকরভাবেই রান তোলার দিকে তাদের মনযোগ। এটাকেই তারা বিপণনে পরিণত করেছে, এটাই তারা দেখতে চায় এবং একেই তারা মূল্যায়ন করে। কারণ, এই অ্যাপ্রোচ দিয়েই তারা অন্যদের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য ছক্কা মারা ব্যাটসম্যানের দলে পরিণত হয়েছে।
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ী দলের কোচ ফিল সিমন্স বলেন, ‘আমরা জানি আমাদের দলে ৮ নম্বর পর্যন্ত বাউন্ডারি হিটারস ব্যাটসম্যান রয়েছে। এ কারণে আমরা ডট বল নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নই। কারণ, আমাদের আশা, মাত্রাতিরিক্ত ডট বলগুলোর ঘাটতিকে ব্যাটসম্যানরা পুষিয়ে দেবে। গেইল যদি ৬০ বল খেলে এবং এর মধ্যে ২০টি ডট বল দেয়, তবুও আমার বিশ্বাস সে সেঞ্চুরি করবে।’
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের কথা তো সবারই জানা। সেবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ওভারে কার্লোস ব্র্যাথওয়েটের টানা চার বলে চারটি ছক্কার কথা ক্রিকেটপ্রেমীদের এত সহজে ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ওই চারটি ছক্কাই প্রমাণ করে দিয়েছে, টি-টোয়েন্টিতে অন্যদের চেয়ে দারুণ একটি দল তারা।
সেমিফাইনালে মুম্বাইতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হারিয়েছিল স্বাগতিক ভারতকে। অথচ ওই ম্যাচে ভারতের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ডট বল খেলেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২৯টির বিপরীতে ৫০টি। অথচ ভারত যেখানে মাত্র ৪টি ছক্কার মার মেরেছিল, সেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজ মেরেছে ১১টি ছক্কার মার। মনেই হচ্ছে যেন, ছক্কার মারকে একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে ক্যারিবীয়রা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১২ এবং ২০১৬ ফাইনাল ও সেমিফাইনাল মিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানরা ছক্কা মেরেছে ৩৯টি। বিপরীতে এই দুই বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ও ফাইনালে বাকি সব দল মিলে ছক্কা মেরেছে কেবল ১৪টি। ক্যারিবীয়দের সঙ্গে পার্থক্যটা তো এখানেই ফুটে ওঠে।
ক্রিকেটে ছক্কা মারতে যাওয়াটাও কম ঝুঁকির কাজ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাটসম্যান ব্যর্থ হতে পারে। বলকে উঁচিয়ে মারতে গিয়ে ধরা পড়তে পারে মাঠের মধ্যেই। এমন ঘটনা প্রায়ই তো ঘটছে। তবুও, টি-টোয়েন্টিতে ছক্কা মারার চেষ্টার কমতি নেই। ব্যাটসম্যানরা প্রতিনিয়তই চেষ্টা করছেন, ছক্কা মারার কৌশলকে আরও কত উন্নত করা যায়, আরও কত ভালো করা যায়। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা।
নোট : লেখাটা ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ম্যাগাজিন ক্রিকেট মান্থলিতে ৬ জানুয়ারি প্রকাশিত লেখক টিম উইমোরের লেখা ‘দ্য সিক্স হিটিং টিম’ থেকে ইষৎ সংক্ষেপিত আকারে লেখা।
আইএইচএস/আরআইপি