সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। বাংলাদেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে। ফেসবুক ব্যবহারকারীর বিবেচনায় ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় শহর। কিন্তু এত প্রিয় হলেও ফেসবুকটা আমরা ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারি, এটা বলা যাবে না।
Advertisement
নানান ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ইদানীং ফেসবুক অনেক সতর্ক। কিন্তু একসময় মানুষ ঢালাওভাবে ফেসবুক একাউন্ট খুলতে পেরেছে। বাংলাদেশের আড়াই কোটি ফেসবুক একাউন্টের একটা বড় অংশ ফেক বা ছদ্মবেশী।
আবার অনেকের একাধিক একাউন্ট আছে। তার মানে বাংলাদেশে ভার্চুয়াল জগতেরও একটা সুপার ভার্চুয়াল ছায়া জগত আছে। যে অংশটি চেনা-অচেনার মাঝে, আলো আঁধারির জগৎ। যারা নিজের নাম লুকিয়ে ফেসবুকে আসেন, নিশ্চিতভাবেই তার উদ্দেশ্য ভালো নয়।
নাম লুকিয়ে বা অন্যের নামে একাউন্ট খুলে তারা প্রতিপক্ষকে গালাগাল করে, হৃমকি দেয়, মানুষকে ব্ল্যাকমেইল করে। ফেসবুকে সবচেয়ে বিপদজনক হলো এই ফেক একাউন্ট। এই ফেক একাউন্ট এতটাই ভয়ঙ্কর, ফেসবুককেই কখনো কখনো ফেকবুক মনে হয়। সুখের কথা, ইদানীং ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ফেক একাউন্টের ব্যাপারে সতর্ক ও কঠোর হয়েছে।
Advertisement
ফেসবুক কিন্তু গণমাধ্যম নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কিন্তু ইদানীং কখনো কখনো ফেসবুক গণমাধ্যমের চেয়েও প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। কখনো কখনো তথ্যের প্রাথমিক উৎসও ফেসবুক। যেহেতু কোনো সম্পাদক নেই, কোনো জটিলতা নেই; তাই সাধারণ মানুষ মনের কথাটি সবার আগে ফেসবুকে বলে দেয়। দ্রুত জনমত গঠনে ফেসবুকের বিকল্প নেই।
ফেসবুকে ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় অনেক অপরাধীকে ধরা গেছে, বিচার করা গেছে। গণমাধ্যম কিছুটা নিয়ন্ত্রিত, অনেকটা দায়িত্বশীল। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সে বালাই নেই। তাই মানুষ মনের সুখে তাদের মতপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ফেসবুককে বেছে নেয়। তবে ফেসবুক যেমন তথ্য ছড়ায়, তেমনি গুজবও ছড়ায়।
অন্তত ১২ বছর আগে ফেসবুকে আমার একাউন্ট খুলেছি। তবে সক্রিয় বছর পাঁচেক ধরে। ইদানীং ফেসবুক আমার দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। ফেসবুককে আমি বহুবিধ উপায়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করি।
প্রতিদিন সকালে আমি নিজের তোলা ফুলের ছবি দিয়ে বন্ধুদর 'শুভ সকাল' জানিয়ে দিন শুরু করি। ফেসবুককে আমি আমার মতপ্রকাশের খোলা জানালা হিসেবে ব্যবহার করি। আমার লেখালেখি, আমরা ভাবনা প্রকাশ করি ফেসবুকে। আমার একাউন্টে প্রায় ৫ হাজার বন্ধু, ৫৫ হাজারেরও বেশি ফলোয়ার রয়েছে। তাদের অনেকের সাথেই আমার ফেসবুকের মাধ্যমেই যোগাযোগ হয়েছে। কারো কারো সাথে সে যোগাযোগ ব্যক্তিগত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
Advertisement
ফেসবুক বন্ধুদের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। আমার সব লেখালেখির লিঙ্ক আমি ফেসবুকে শেয়ার করি। একটি ফেসবুক পেজ থাকলেও সেটি সক্রিয় নয়। আমার কোনো ওয়েবসাইট নেই। তাই আমার সামাজিক যোগাযোগের একমাত্র উপায় আমার ফেসবুক প্রোফাইল। কিন্তু এই আমিও ফেক একাউন্টের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছি।
আমি সেলিব্রেটি নই, তবে একেবারে অচেনাও নই। আমি তিন দশক ধরে মূলধারার সাংবাদিকতার সাথে জড়িত। আমি নিয়মিত টক শো করি, লেখালেখি করি। বিভিন্ন বিষয়ে আমার লেখা ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু গত ১৯ ডিসেম্বর বিকেল ৩টা ৫৩ মিনিটে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আমাকে একটি মেইল পাঠায়। তার শিরোনাম ছিল, 'আপনার বিরুদ্ধে কেউ একজন ছদ্মবেশের অভিযোগ এনেছে।' মেইলে লেখা ছিল, 'দেখে মনে হচ্ছে প্রভাষ আমিন নামের অ্যাকাউন্টটিকে কারো পরিচয় নকল করার জন্য নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে, যা আমাদের সম্প্রদায়ের মানদণ্ডের বিরুদ্ধে যায়। আপনি যদি মনে করেন যে আমরা কোনো ভুল করেছি, তাহলে অনুগ্রহ করে আপনার ফটো, নাম এবং জন্ম তারিখ রয়েছে এমন একটি আইডি বা অন্যান্য নথিসহ এই বার্তাটির উত্তর দিন।'
ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের চাহিদামত আইডি সরবরাহ করেছি। বারবার যোগাযোগ এবং নানামুখী ভেরিফিকেশন শেষে গত ৭ জানুয়ারি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আমার একাউন্টটি ফেরত দেয়। তবে নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে আমি ফেসবুকে ছিলাম না। যারা আমার বিরুদ্ধে ছদ্মবেশের অভিযোগ এনেছে তাদের অনেকেই ছদ্মবেশী। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই আমার মত সবার আইডিই রিভিউ করবে।
ফেসবুকে আমার বন্ধু তালিকায় সব মতের মানুষ আছে। আমার সব পোস্ট পাবলিক। তাই ফলোয়াররাও নিয়মিত স্ট্যাটাস ও শেয়ার করা লিঙ্কে মতামত দিতে পারতেন। আমার ওয়ালে সবসময় ভিন্নমতকে স্বাগত জানাই। ভিন্নমতের মানুষদের সাথে আমার দিনের পর দিন তর্ক হয়, কিন্তু কখনো ঝগড়া হয় না।
শুধু যারা ভিন্নমত জানাতে এসে অশ্লীল গালাগাল করেন, তাদের আমি এড়িয়ে চলি। আমি নিজেকে কখনো নিরপেক্ষ দাবি করিনি। আমি আদর্শ নিরপেক্ষ নই, তবে দলনিরপেক্ষ। আমি সবসময় সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, মানবতার পক্ষে, বাংলাদেশের পক্ষে।
বিভিন্ন স্ট্যাটাসে আমাকে দুইপক্ষের গালিই খেতে হয়। বুদ্ধিজীবী দিবসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. কামালের মেজাজ হারানোর প্রতিবাদ করায় একপক্ষ গালি দিয়েছে। সেদিনই ড. কামালের গাড়িবহরে হামলার প্রতিবাদ করায় আরেকপক্ষ গালি দিয়েছে। ইদানীং ফেসবুকে গালির সংখ্যা বাড়ছিল, ছিল নানা ধরনের হুমকিও।
তবে সবার মতপ্রকাশের প্রতি শ্রদ্ধা আছে বলে বরাবরই আমার ফেসবুক সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। যে কেউ আমাকে যা ইচ্ছা ট্যাগ করতে পারতেন। এই উন্মুক্ত থাকার সুযোগেই এমন অনেক ছদ্মবেশী শত্রু জুটেছিল, যারা আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার গলাটিপে ধরতে চেয়েছিল। সাময়িকভাবে তারা সফলও হয়েছে।
আমি সবসময় মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলি। সব মতের মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান জানাই। একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে, আমি কখনোই ফেক নিউজ, গুজব ছড়াই না, ভিন্নমতকে স্বাগত জানাই। যারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেন, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেন; তারা দল বেধে রিপোর্ট করে আমার আইডিটি কিছুদিনের জন্য নিষ্ক্রিয় করে দিলেন।
এ বড় বেদনার। তবে ১৯ দিন পর ফিরে পেয়েও আমার অবস্থান একটুও বদলায়নি। সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি আমার এখনও পূর্ণ শ্রদ্ধা আছে। আমার ফেসবুক ওয়াল এখনও সবার জন্য উন্মুক্ত। অশ্লীল গালাগাল ছাড়া সব ধরনের সমালোচনা, ভিন্নমতকে আমি আগের মতই স্বাগত জানাই।
সত্যি বলতে ফেসবুকবিহীন ১৯টি দিন আমার দারুণ কেটেছে। আমার দিন অন্তত ২ ঘণ্টা বড় হয়ে গিয়েছিল। এ সময় আমি পড়ার জন্য বেশি সময় পেয়েছি, লেখালেখি বেড়ে গিয়েছিল। ফেসবুকের বন্ধু-ফলোয়ারদের মিস করছি বটে, তবে অসামাজিক জীবন উপভোগ করছি।
আজ থেকে যদি সবার জন্য ফেসবুক বন্ধ হয়ে যায়, আমার চেয়ে বেশি কেউ খুশি হবেন না। কিন্তু বাস্তবতাটাই এমন ফেসবুকে না থাকলে আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। তাই ফেসবুক ছাড়া এখন আর দিন চলে না।
১৯ দিন পর ফিরে এসে আমি আবার ফেসবুকে সক্রিয় হচ্ছি। সবার সাথে নতুন করে যোগাযোগ হচ্ছে। অনুপস্থিতির সময় যারা খোঁজ নিয়েছেন, তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। তবে আমার প্রত্যাশা আমাদের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা আরো বাড়ুক। ভিন্নমতের প্রতি যেন আমাদের শ্রদ্ধা থাকে। মতে না মিললে যেন আমরা যুক্তি দিয়ে তার জবাব দেই, রিপোর্ট করে কণ্ঠরোধ করে নয়।
শত ফুল ফুটুক, শত মত বিকশিত হোক। ফেসবুক যেন আমাদের সবার মতপ্রকাশের খোলা জানালা হয়, কারো কণ্ঠরোধের অস্ত্র যেন না হয়।
এইচআর/জেআইএম