দেশজুড়ে

মসজিদের দানবাক্সে পাওয়া গেল কোটি টাকা

নেত্রকোনার সাম্মি আক্তার অনেক দিন ধরেই আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু নানা জটিলতায় তার ভিসা হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে তিনি মানত করলেন ভিসা পেলে তিনি কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের এসে নিজ হাতে একটি কোরআন শরীফ ও টাকা দান করবেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই হাতে পান স্বপ্নের দেশ আমেরকিার ভিসা। তাই ছেলে, স্বামী ও মাকে নিয়ে মানত আদায় করতে ছুটে এসেছেন কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদে।

Advertisement

ঈশ্বরগঞ্জের মিনতি রানী সরকার সন্তানের মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন না অনেক বছর। এ মসজিদে মানত করার পর তার কোল আলো করে এসেছে একটি পুত্র সন্তান। তাই মানতের একটি ছাগল নিয়ে স্বামী-সন্তানসহ পাগলা মসজিদের এসেছেন।

কিশোরগঞ্জ শহরের নরসুন্দা নদীর তীরে ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ। এ মসজিদে ইবাদত-বন্দেগী করলে বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। রোগ-শোক বা বিপদে মসজিদে মানত করলে মনের বাসনা পূর্ণ হয়। এমন বিশ্বাস থেকে এখানে প্রতিনিয়ত দান-খয়রাত করে থাকে মানুষ।

তবে সব কিছু ছাপিয়ে মসজিদের সিন্দুকে দানের টাকার পরিমাণ যেটি দাঁড়ায় তা রীতিমতো বিস্ময়কর। প্রতি তিন বা বা চার মাস পর পর মসজিদের সিন্দুক খোলা হয়। আর প্রতিবারই টাকার পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় কোটি টাকা!

Advertisement

পাগলা মসজিদের দানবাক্স খুললেই বেরিয়ে আসে কোটি টাকা, ডলারসহ বিদেশি মুদ্রা এবং স্বর্ণের গহনা। দানবাক্স ছাড়াও প্রতিদিন হাজার হাজার নারী-পুরুষ এ সমজিদে দান করেন, চাল, মাছ, ফল-ফলাদি, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু।

গত শনিবার (১৯ জানুয়ারি) জেলা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মসজিদের ৫টি লোহার দানবাক্স খোলা হয়। আর এতে নগদ টাকা পাওয়া যায় এক কোটি ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৩ টাকা। এর আগে গত বছরের ৭ জুলাই দানবাক্সগুলো থেকে ৮৮ লাখ ২৯ হাজার ১৭ টাকা পাওয়া গিয়েছিল।

একইভাবে গত বছরের ১৩ জুলাই ৮০ লাখ ৪৯ হাজার ৮১ টাকা, ৩১ মার্চ তারিখে ৮৪ লাখ ৯২ হাজার ৪ টাকা, এবং ৬ জানুয়ারি তারিখের দানবাক্সগুলো থেকে এক কোটি ২৭ লাখ ৩৬ হাজার ৪৭১ টাকা পাওয়া যায়। গত বছর শুধুমাত্র দানবাক্স থেকে নগদ ৫ কোটি ৩৫ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৭ টাকা পাওয়া যায়। এর আগে ২০১৭ সালে দুইবারে টাকা পাওয়া যায় ২ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার ২ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিবার সকালে এক যোগে মসজিদের ৬টি দানবাক্স খোলা হয়। বড় বস্তায় টাকা ভরে দিনভর চলে গণনা।প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে টাকা গণনা করেন বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা। মসজিদ কমপ্লেক্স মাদরাসার কয়েক’শ ছাত্র টাকা গণনায় সহযোগিতা করেন।

Advertisement

পাগলা মসজিদের প্রধান আয় মূলত মানুষের দানের টাকা। মুসলমান ছাড়াও অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও এখানে টাকা দান করেন। কয়েক বছর আগে মসজিদটিকে পাগলা মসজিদ ইসলামী কমপ্লেক্স নামকরণ করা হয়েছে। মসজিদের আয় দিয়ে কমপ্লেক্সের বিশাল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে পাগলা মসজিদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। মসজিদের আয় থেকে জেলার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদানসহ বিভিন্ন সেবামূলক খাতে সাহায্য দেয়া হয়। বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসার জন্য মসজিদের তহবিল থেকে অর্থ সহায়তা দেয়া হয়।

পাগলা মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. শওকত উদ্দিন ভূইয়া জানান, প্রতিদিন গড়ে হাজার নারী-পুরুষ মসজিদের এসে মানত আদায় করেন। তবে শুক্রবার এ সংখ্যা ৫/৭ হাজারে ওঠে। আগতরা সিন্দুকে নগদ টাকা দান করেন। আর মানতের বিভিন্ন সামগ্রী গ্রহণের জন্য আলাদা লোক রয়েছে। প্রতিদিনের দান সামগ্রী বিকেলে কমিটির লোকজনের উপস্থিতিতে নিলামে বিক্রি করা হয়।

পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী জানান, এ মসজিদের টাকা স্থানীয় একটি ব্যাংকে জমা রাখা হয়। মসজিদ কমপ্লেক্সের আয় থেকে জেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অনুদান দেয়া হয়। এ ছাড়া অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার জন্য মসজিদের ফান্ড থেকে এককালীন অনুদান দেয়া হয়।

পাগলা মসজিদের সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে জনশ্রুতি আছে, কিশোরগঞ্জ শহরের হারুয়া এলাকায় পাগলবেশী এক আধ্যাত্মিক পুরুষ খরস্রোতা নরসুন্দা নদীর মধ্যস্থলে মাদুর পেতে ভেসে এসে বর্তমান মসজিদের কাছে ধ্যানমগ্ন হন। তাকে ঘিরে আশেপাশে অনেক ভক্তকূল সমবেত হয়। ওই পাগলের মৃত্যুর পর তার সমাধির পাশে পরবর্তীতে এই মসজিদটি গড়ে ওঠে। ফলে কালক্রমে মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ নামে পরিচিতি পায়।

নূর মোহাম্মদ/আরএআর/জেআইএম