খুলনা মহানগরীতে আবারো আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে ইয়াবা বাণিজ্য। আর এসব মাদকের প্রধান ব্যবসায়ীর বেশিরভাগই নারী ও তরুণী। গাঁজা, ফেনসিডিল ও হেরোইনের পর মাদকসেবিদের নেশার তালিকায় ক্রমশ চাহিদা বাড়ছে ইয়াবা নামক উত্তেজক ট্যাবলেটের। আর ওই নেশার প্রথম শিকার হচ্ছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও উঠতি বয়সি যুবকরা। প্রতিমাসে গড়ে কয়েক লাখেরও বেশি পিস ইয়াবা বিকিকিনি হচ্ছে খুলনায়। উৎসব উপলক্ষে এসব বিকিকিনি বেড়ে যায় বহুগুণে। ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে খুলনায় কমপক্ষে ১০ জন পাইকারি এবং ২৫ জন খুচরা বিক্রেতাসহ ১০২ জন মাদক সম্রাট জড়িত রয়েছেন বলে জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। যার অধিকাংশই নারী ও তরুণী। প্রতিদিনই দু’একজন নারী ও তরুনী মাদক বিক্রেতা গ্রেফতার হলেও মাদকের সিন্ডিকেট উৎপাটন করতে পারছে না পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। সর্বশেষ, গত রোববারও নগরীর শিল্প ব্যাংকের পেছনে রঞ্জি বেগম নামে এক নারীকে ছয় মাসের সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীসহ উপজেলা পর্যায়ে ফেনসিডিল, গাঁজা ও ইয়াবার কালো থাবা পড়েছে। মাদক সম্রাটদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ নারী। এ নারী মাদক ব্যবসায়ীরা মোটা অঙ্কের টাকার মালিক হয়েছেন মাদক ব্যবসা করে। গ্রেফতার এড়াতে তারা প্রশাসনের অনেকের সঙ্গে সখ্যতা রক্ষা করে চলেন। গ্রামাঞ্চলে গাঁজা ও ফেনসিডিলের চাহিদা বেশি। ইয়াবার চাহিদা মহানগরীর তরুণদের মধ্যে। এ সূত্র মতে, খুলনায় প্রতি মাসে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা মূল্যের মাদক বিকিকিনি হয়। এদিকে সর্বনাশা এ মরণ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৪৭ লাখ। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, খুলনায় সাধারণত ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন ও ফেনসিডিল সেবনকারীর সংখ্যা বেশি। তবে গত পাঁচ বছর ধরে ইয়াবা নামের ট্যাবলেট মাদকের মার্কেট দখল করে নিয়েছে। মাদকের রাজ্যে ইয়াবাই এখন সর্বনাশা নীল নেশার রাজা।বিশেষ করে অভিজাত ধনাঢ্য পরিবারের তরুণ-তরুণীদের কাছে ইয়াবা নামের মাদক খুবই প্রিয়। খুলনায় সাধারণত তিন ধরনের ইয়াবার খোঁজ পাওয়া যায়। গায়ে ‘ওয়াই’ লেখা ইয়াবা খুচরা বাজারে প্রতি পিস ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। ‘আর-সেভেন’ লেখা ভালোমানের ইয়াবা প্রতি পিস ৫শ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা। এছাড়া চম্পা সুপার নামের ইয়াবা বাজারে নতুন এসেছে। দেশীয় এ ইয়াবার দামও কম। গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানায়, ভারত, বার্মা ও নেপাল থেকে চোরাইপথে মাদক ঢুকছে বাংলাদেশে। সীমান্তরক্ষী ও পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই রেল ও সড়ক পথে মাদকদ্রব্য আনা হয়ে থাকে। সীমান্ত গড়িয়ে আনা ভারতীয় মাদকদ্রব্য নানা কৌশলে এনে খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর, রেলগেট, বৈকালী জংশন ও খুলনা রেল স্টেশনের অদূরে নামানো হয়। বিভিন্ন সড়কপথে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, ট্যাক্সিযোগে ও নৌপথে মংলা হয়ে বিভিন্ন ধরনের মাদক খুলনায় প্রবেশ করছে। খুলনা রেল স্টেশন, শেখপাড়া, গোবরচাকা, লবণচোরা, মিস্ত্রিপাড়া ও রেলগেট এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে এর মজুদ গড়ে তোলা হয়। সেখান থেকে তা বিক্রির জন্য নগরীর প্রায় দুইশ পয়েন্টে পাঠানো হয়। তাছাড়া খুলনা শহর মাদকদ্রব্য পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এজন্য সংঘবদ্ধ পাচারকারী দলও রয়েছে। নগরীর ঘাট এলাকা, বড় বাজার, নতুন বাজার ও লবণচরা এলাকা থেকে নদীপথে লঞ্চ ও ট্রলারযোগে এবং সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল ও রূপসা ঘাটের ওপাড় থেকে সড়কপথে বাসসহ অন্যান্য মাধ্যমে নানা প্রকারের মাদকদ্রব্য পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র এডিসি শেখ মনিরুজ্জামান মিঠু জাগো নিউজকে জানান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স লেভেলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইয়াবাসেবির সংখ্যা বেশি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ধনাঢ্য পরিবারের ছেলে-মেয়েরাই ইয়াবার প্রতি বেশি আসক্ত। তবে এখন কেএমপি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরো বেশি তৎপর। প্রতিদিনই মাদকসহ বিক্রেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এটা প্রমাণ করে পুলিশ সোচ্চার রয়েছে। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ধীরাজ মোহন বিশ্বাস জাগো নিউজকে জানান, নগরীতে মাদক নীল ছোবল দিয়েছে। ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে মাদকের। সবচেয়ে বেশি আসক্ত ফেনসিডিলে, তার পর হেরোইন ও গাঁজা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিচালনাধীন মাদকাসাক্ত নিরাময় কেন্দ্রে কোনো চিকিৎসক নেই। তাদের কোনো কার্যক্রমও পরিলক্ষিত হয় না। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য ১৫টি বেড থাকার কথা থাকলেও এমন কোনো অবস্থা দেখা যায় না।এমজেড/পিআর
Advertisement