ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। ১৯৯৫ সাল থেকে এর শুরু। দুই যুগ ধরে প্রতি বছরই এর আয়োজন হচ্ছে। এবারও গত ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে ২৪তম ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা- ২০১৯’।
Advertisement
মেলার নামের সঙ্গে যুক্ত আছে ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটি। বাংলা একাডেমির অভিধান অনুযায়ী, ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দের অর্থ ‘সব জাতি বা রাষ্ট্রের মধ্যে প্রচলিত’। কিন্তু এই দুই যুগেও সব জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে প্রচলিত বা স্থান করে নিতে ব্যর্থ হয়েছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। এমনটি মনে করেন অনেকে। যদিও এ ব্যর্থতার কথা সরাসরি স্বীকার করছেন না সংশ্লিষ্টরা। এবারের মেলায় অংশ নিয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের স্বাধীন ১৯৪টির মধ্যে ২৬টি রাষ্ট্র। এ হিসাবে বাণিজ্য মেলায় স্বাধীন দেশগুলোর অংশগ্রহণের হার মাত্র (প্রায়) ১৩ শতাংশ। মেলায় প্যাভিলিয়ন, মিনি-প্যাভিলিয়ন, রেস্তোরাঁ ও স্টলের মোট সংখ্যা ৬০৫টি। বাংলাদেশ ছাড়া ২৫টি দেশের ৫২টি প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিয়েছে। এই হিসাবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো মেলার প্রায় ৯ শতাংশ স্থানজুড়ে অবস্থান করছে। বাকি ৯১ শতাংশ দেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে।
মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন পণ্য ও সেবার সঙ্গে দেশি-বিদেশি ভোক্তাদের পরিচিত করা। ৯ থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত এই ১০ দিনের মধ্যে পাঁচদিন এ প্রতিবেদক বাণিজ্য মেলায় ঘুরেছেন। এর মধ্যে বিদেশি ক্রেতা-দর্শনার্থী খুব কম পরিলক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশি অনেক ক্রেতা-দর্শনার্থী এ ব্যাপারে আক্ষেপ করে বলেছেন, নাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা, কিন্তু মেলাটা কি সত্যিই আন্তর্জাতিকভাবে সাড়া ফেলেছে? গত ২৪ বছরেও এ মেলা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্থান করে নিতে পারেনি। বলতে হবে, এ ক্ষেত্রে আমরা ব্যর্থ। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলতে না পারলেও এর উদযাপন-আয়োজনে কোনো ঘাটতি থাকে না। রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারপ্রধান এর উদ্বোধন করেন। এবারও ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। যদিও এ ব্যর্থতার কথা সরাসরি স্বীকার না করলেও পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাণিজ্য মেলার আয়োজন করে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মেলা শুরুর আগের দিন শেরে বাংলানগরের মেলা প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এতে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, বাণিজ্য সচিব মো. মফিজুল ইসলাম, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস-চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্যসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
এ সময় এক সংবাদকর্মী জানতে চান, 'এটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। এতে ২৫টি দেশের ৫২টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আমরা যেটা দেখছি, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ার হলেও রাজধানীর নিউ মার্কেটকে এখানে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। বাইরের বড় বড় কোম্পানিগুলোকে খুব-একটা দেখা যাচ্ছে না। যদিও মেলায় বিদেশি ছোট ছোট কিছু প্রতিষ্ঠান আসছে। আমরা সেই অবস্থানে কবে নাগাদ যেতে পারব?' বাণিজ্যমন্ত্রী, সচিবসহ সবার পক্ষ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে বলা হয় রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস-চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্যকে। তখন পরোক্ষভাবে এ ব্যর্থতা স্বীকার করে বিজয় ভট্টাচার্য বলেন, 'তারা (বিদেশি বড় কোম্পানি) মূলত সোর্সিংয়ের জন্য মেলায় আসে। আমরা কিন্তু সোর্সিং মেলা করছি না। আমরা অবকাঠামো তৈরি করছি পূর্বাচলে। তারা একটা গাড়ি নিয়ে আসবে, কিংবা অন্যকিছু নিয়ে আসবে। আমরা রাখব কোথায়, জায়গা নেই আমাদের। ২০২০ সালে আমরা আশা করছি, পূর্বাচলে প্রর্থম সোর্সিং মেলা করতে পারব। সোর্সিং মেলা ও কনজ্যুমার মেলা, দুটো আপনারা কীভাবে আলাদা করবেন - জানতে চাইলে বিজয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো এ ধরনের কনজ্যুমার ফেয়ারে কোথাও যায় না। এটা কিন্তু কনজ্যুমার ফেয়ার। এ মেলাটা আমরা কেন করি? আজ ২৪তম মেলা শুরু হলো। এর আগে ২৩টি মেলা হয়েছে। এই মেলার কনসেপ্টটা কী ছিল? কনসেপ্টটা হলো- দেশীয় কোম্পানিগুলোকে যাতে প্রমোট করা যায়।’ ‘এ আন্তর্জাতিক মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য দেশি পণ্যের ব্র্যান্ড তৈরি করা’- বলেও দাবি করেন ইপিবির ভাইস-চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আমরা এ মেলায় দেশীয় পণ্যকে প্রোমোট করি এ জন্য যে, দেশীয় কোম্পানিগুলো নিজেদের রুটটাকে এ মাটিতে প্রোথিত করতে পারে। এটা হলো- বর্তমান বিশ্বে বাণিজ্যের বড় চ্যালেঞ্জ। ব্র্যান্ডগুলো দখল হয়ে গেছে উন্নত বিশ্বের কয়েকটা কোম্পানির হাতে। একেকটা কোম্পানি কয়েকটা ব্র্যান্ডকে কন্ট্রোল করছে। তারা অর্ডার না দিলে পৃথিবীর অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।’
Advertisement
‘বাংলাদেশ এমন একটা দেশ, যেখানে ব্র্যান্ডের ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে। আমরা যে মেলাটা করি, সেটা মূলত ব্র্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জন্য। মেলা শুরুর দিকে দেশীয় ব্র্যান্ডের নাম খুব-একটা শোনা যেত না। কিন্তু এখন দেশে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড আছে। এই নামগুলো একটা শিশু দেখলেও চিনতে পারে, এটা এই ব্র্যান্ড ওটা ওই ব্র্যান্ড'- যোগ করেন বিজয় ভট্টাচার্য। এ বিষয়ে ব্যবসায় গবেষণা ব্যুরোর চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী আক্কাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ উদ্যোগ সফল করার জন্য বাংলাদেশের বিদেশি দূতাবাসগুলোকে ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি (অর্থনৈতিক তৎপরতা) বাড়াতে হবে। এটা করলেই আমাদের মেলায় বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাড়বে, থাইল্যান্ড যেভাবে মেলা করে থাকে।’ ‘আমরা যদি বিদেশি গণমাধ্যমে তুলে ধরতে পারি, তাহলে বিশ্ববাসীর সচেতনতা বাড়বে। সচেতনতা বাড়লে ওরাও বেশি আসবে। কারণ, এখানে শ্রম সস্তা, মান সস্তা। এগুলো তো দেশের বাইরেও তুলে ধরতে হবে’- যোগ করেন তিনি। আলী আক্কাস বলেন, ‘আমাদের এটা তো বিশ্ব প্রতিযোগিতার বাজার। এখনও অংশগ্রহণ কম, হয়ত বাড়বে। কেবল শুরু। সচেতনতা বাড়বে, বাইরের ক্রেতা আসবে। উদ্যোগটা সফল, উদ্যোগটা ভালো। বাণিজ্য মেলাকে এখনই সফল বা ব্যর্থ বলা যাবে না।’ পিডি/জেডএ/এমএআর/এমএস