একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের নিয়ে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো চলচ্চিত্র বা নির্মাণ নেই বললেই চলে। কোথাও দেখা যায়নি মুক্তিযুদ্ধের পর কেমন কেটেছে বীরাঙ্গনাদের জীবন। পুরুষতান্ত্রিক ও কুসংস্কারাছন্ন সমাজে সেইসব নারীরা সম্মান নিয়ে আর দশটা নারীর মতো বাঁচতে পেরেছেন কী?
Advertisement
সেই গল্প জানাতে দারুণ এক নির্মাণ নিয়ে হাজির হয়েছেন পরিচালক লিসা গাজী। তিনি নির্মাণ করেছেন ডকুমেন্টারি ‘রাইজিং সাইলেন্স’। এখানে তার নির্মাণের প্রধান চরিত্র নয়জন বীরাঙ্গনা। চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি আয়োজিত ১৭তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে, ১৮ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে সন্ধ্যা ৭টায়।
ছবিটি নিয়ে জাগো নিউজে একান্ত সাক্ষাতকারে কথা বলেছেন পরিচালক নির্মাতা লিসায়া গাজী। তিনি জানালেন এই চলচ্চিত্র নির্মাণের ভাবনা ও পেছনের গল্প। তুলে ধরা হলো আলাপের চুম্বব অংশ।
জাগো নিউজ : প্রথমেই জানতে চাই বীরাঙ্গনাদের নিয়ে ডকুমেন্টারি নির্মাণের ইচ্ছেটা কেন হলো?লিসা গাজী : এটা নিজের ভেতরের তাড়না বলতে পারেন। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। কিন্তু তাদের কখনো কাছ থেকে দেখা হয়নি। আমি বারবার ভেবেছি একজন নারী লাঞ্ছিতা হলে এই সমাজে খুব বাজেভাবে তাকে টিকতে হয়। সেখানে যারা একাত্তরে দিনের পর দিন দুর্বিষহ সময় কাটিয়েছেন তারা কীভাবে দিন কাটিয়েছেন? তাদের সেইসব দিনগুলো সম্পর্কে আজকের প্রজন্ম কতটুকু জানে? এইসব নানা প্রশ্ন মনে নিয়েই কাজটি করার অনুপ্রেরণা পাই।
Advertisement
পঁচাত্তরের পর দেশে ইতিহাসের একটা বিরাট অংশে পরিবর্তন চলে আসে। অনেক ভুল ইতিহাস শিক্ষা দেয়া হয়েছে। ভুল তথ্য সঠিক বলে চালানো হয়েছে। সেইসব ইতিহাসে বঞ্চিত ছিলেন বীরাঙ্গনারা। এটা আমাকে বেদনা দিয়েছে। তাই সবসময় তাদের সঠিক ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের অবদান তুলে ধরার আগ্রহ কাজ করেছে সবসময়।
আমি প্রায়ই ভেবেছি, আমার মা-ও তো এই নারীদের ভাগ্য বরণ করতে পারতো। আমিও তো এনাদের মতো দুর্ভাগা হতে পারতাম। নির্যাতন আর অত্যাচারের জীবন আমারও হতে পারতো। এই উপলব্দি বারবার আমাকে উৎসাহ দিয়েছে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কিছু করার।
জাগো নিউজ : বীরাঙ্গনাদের নিয়ে এই নির্মাণে আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই.....লিসা গাজী : বলতে পারেন দারুণ এক অভিজ্ঞতা। ২০১৫ সালে আমি এই তথ্যচিত্রটি নির্মাণের কাজে হাত দিই। অনেকটা সময় তাদের সাথে কাটিয়েছি। অনেক অজানা গল্প, অজানা অনেক তথ্য আমি জেনেছি। সেইসব দর্শকরাও জানতে পারবেন ছবিটি দেখার পর। কত কষ্ট, কত অপবাদ, মানসিক অত্যাচার সহ্য করে তারা টিকে ছিলেন।
অনেক বীরাঙ্গনাকে নষ্টা মেয়ে আখ্যা দিয়ে গ্রাম থেকেও বের করে দেয়া হয়েছে। তাদের সন্তানেরাও নানা কটু কথা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এইসব সহ্য করে তারা যে ওভারকাম করেছেন এটা অবিশাস্য। আমি নয়জন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে কাজটি করেছি। তাদের অনেকেই আজ পৃথিবীতে নেই। তাদের আত্মার শান্তি পাক। এইসব মহীয়সী নারীদের গল্প জানার জন্য সবাইকে আমি আমন্ত্রণ জানাচ্ছি ১৮ জানুয়ারি ছবিটি দেখতে আসার জন্য।
Advertisement
জাগো নিউজ : সাধারণত বীরাঙ্গনারা মিডিয়া বা প্রকাশ্যে নিজেদের গল্প বলা এড়িয়ে যান। সেক্ষেত্রে আপনি এইসব বীরঙ্গনাদের কেমন করে তথ্যচিত্রের জন্য রাজি করালেন?লিসা গাজী : দেখুন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পর কিছু মানুষ এদের রক্তাক্ত করেছে সামাজিকভাবে হেয় করে। আবার কিছু মানুষ এনাদের ব্যবহার করে অনেক ফায়দা নিয়েছেন। সেটা ওই নারীরা খুব ভালোই বুঝতে পারেন। তারা মনে করেন মিডিয়ার মানুষ কেবল তাদের আবেগ বিক্রি করে। তাদের জন্য মমতাটা মন থেক্র ধারণ করে না। সেজন্যই তারা এড়িয়ে চলেন।
তারা মমতা চান, আদর চান, সম্মান চান। আমি সেই হৃদয় নিয়ে তাদের কাছে গিয়েছি। অনেকদিন তাদের সঙ্গে মিশেছি। তাদের এটা বুঝিয়েছি আমার কর্মটা তাদের সম্মানিত করার জন্য। আমি যে নির্মাণটি করেছি সেটি যারা দেখবেন সবাই বীরাঙ্গনাদের জন্য হাহাকার প্রকাশ করবেন, তাদের সম্মান করবেন। আর এটাই আমি চাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করেন যারা তাদের অবশ্যই চলচ্চিত্রটি দেখা উচিত বলে মনে করি।
যেসব বীর নারীদের বেদনা মিশে আছে আমাদের স্বাধীনতায়, তাদের গুরুত্ব জানুক প্রজন্ম, তাদের যথাযোগ্য সম্মানটা যেন করে সবাই। যত বেশি বীরাঙ্গনাদের জানা যাবে তত বেশি তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে জাতি। একাত্তর পরবর্তী সামাজিক প্রেক্ষাপট তাদের অনুকূলে ছিলো না।
জাগো নিউজ : বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা? লিসা গাজী : আমার সব অভিজ্ঞতাই বিশেষ। তবে একটি অভিজ্ঞতার কথা বিশেষভাবে বলা যায়। এইসব মহীয়সী নারীদের কাছে না গেলে আমি তাদের বিশাল মন ও ত্যাগের কথা কোনোদিন বুঝতে পারতাম না। একজন নারী সে নিজেই অনেকদিন ধরে পাক বাহিনীর হাতে বন্দি। তার মুক্তির কোনো পথ নেই। অথচ নতুন কোনো মেয়েকে ধরে আনা হলে সেই নারী চেষ্টা করেছেন কীভাবে ওই মেয়েটিকে এখান থেকে মুক্তি দেয়া যায়। নিজে মৃত্যুর মুখে থেকে অন্যকে বাঁচানোর এই যে ত্যাগ, এই মানসিকতা- কী অসাধারণ বলুন! একবার ভাবুন, আজকের এই সমাজে এই ত্যাগের কথা কল্পনা করা যায়। তাদের ভাবনাটা ছিলো, যা হয়েছে আমার সাথেই হোক। আর কোনাও মেয়ের জীবন যেন নষ্ট না হয়।!
জাগো নিউজ : আপনি যেসব বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে মিশেছেন যুদ্ধ পরবর্তী তাদের যে অর্থনৈতিক জীবন সেটি কেমন দেখেছেন? লিসা গাজী : প্রতিটি বীরাঙ্গনাই আসলে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন বেশি। ধর্মান্ধ কুসংস্কারের, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের নানাভাবে পিষে ফেলতে চেয়েছে। আর এজন্যই বীরাঙ্গনাদের সঠিক সংখ্যা ও ইতিহাস জানা যায় না।
মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত বা সম্ভ্রান্ত অনেক পরিবারের মেয়েরাও নির্যাতিত হয়েছেন, লাঞ্ছিতা হয়েছেন। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে তারা সেটি স্বীকার করেননি, প্রকাশ্যে আনেননি। তাদের মুখে তালা মেরে দেয়া হয়েছে। কারণ, বীরাঙ্গনা খেতাব দেয়া হলেও সম্মান ছিলো না। করে পঁচাত্তরে রাজনীতির হঠাৎ পরিবর্তন অনেক ক্ষতি করেছে বীরাঙ্গনাদের।
সেইসব ঝড় তুফান পেরিয়েও বীরাঙ্গনারা টিকে ছিলেন, টিকে আছেন। কেউ কেউ সাহস করে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার থেকেও ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণীর মতো মাথা উঁচু করে বাঁচতে পেরেছেন।
এর বাইরে গ্রামে গঞ্জে যারা আছেন বা দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা যারা একাত্তরে দুর্ভাগ্য বরণ করেছিলেন তাদের অনেকেই অর্থনৈথিকভাবে মোটামুটি সচ্ছল। তবে বেশিরভাগই অভাব অনটনে ভুগেছেন অনেকটা সময়।
সন্তানরা বড় হয়ে কাজে গিয়ে হয়তো পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে তাদের।
জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধের পরের বাংলাদেশ নিয়ে বীরাঙ্গনাদের ভাবনা কেমন দেখেছেন? লিসা গাজী : দেখুন আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন একজন সচেতন মানুষ হিসেবে দেশের রাজনীতি, রাজিনীতির বর্তমান পরিস্থিতি, নানা বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করব। কিন্তু বীরাঙ্গনাদের কাছে বাংলাদেশ খুবই ইতিবাচক। তারা ত্যাগী নারী। জীবনকে তারা দেখেছেন মৃত্যুর খুব কাছ থেকে। মরতে মরতে চেয়েছেন দেশটা যেন ভাল থাকে। দেশের মানুষ যেন ভাল থাকে। যখন বেঁচে গেলেন এবং স্বাধীন দেশ পেলেন তখনও তাদের স্বপ্ন সাধারণ। নিজেরা অভাবে পড়েন, নানা সমস্যা বা সামাজিকভাবে হেয় হয়েও চান অন্যরা ভাল থাকুক। দেশ নিয়ে তাদের আক্ষেপ নেই। স্বাধীনতাটাকে তারা বিরাট প্রাপ্তি মনে করেন। তারা গণতন্ত্রের বিশুদ্ধ চর্চাটা অতো বুঝেন না। রাজনীতির মারপ্যাচ, ভাল-মন্দ নিয়ে অতো ভাবেন না। নিজেদের সুখ আহ্লাদ নিয়েও অতো উচ্চাশা নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দল আওয়ামী লীগ সরকারে থাকলে খুশি হন।
জাগো নিউজ : বীরাঙ্গনাদের মুখে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে কিছু শুনেননি? লিসা গাজী : এ আরেক মজার অভিজ্ঞতা। ডকুমেন্টারিটা যখন শুরু করি বীরাঙ্গনারা বারবার 'বাবা বাবা' বলে সম্বোধন করছিলেন। তারা বলছিলেন, বাবা থাকলে এত দু:খ থাকত না। আমি ভাবলাম, হয়তো তারা তাদের বাবার কথা বলছেন। পরে বুঝলাম তারা বঙ্গবন্ধুর কথা বলছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই তো আসলে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছেন। বুঝতে পারলাম বঙ্গবন্ধুই তাদের বাবা। সব বীরাঙ্গনারা যেন সম্মান নিয়ে সমাজে থাকতে পারে, নতুন করে সব শুরু করতে পারে সেটা চেয়েছিলেন। তাই তাকেই বীরাঙ্গনারা বাবা বলেন। এ এক অন্য আবেগ দেখেছি।
জাগো নিউজ : বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সম্পর্কে তাদের ভাবনা কেমন? লিসা গাজী : এখানে আবেগটা বঙ্গবন্ধুর মতো নয়। তবে সবাই আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার সরকারকেই পছন্দ করে। কারণ শেখ হাসিনা বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এই স্বীকৃতি তাদের সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিবারের সদস্যদের কাছে তাদের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। সমাজে মাথা উঁচু হয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে, সংসারে সচ্ছলতা আসছে। তাই এই সরকারের প্রতি তাদের ভালোবাসা আছে।
জাগো নিউজ : এটা আপনার প্রথম নির্মাণ। এরপর কী পরিকল্পনা আছে? লিসা গাজী : এখনো তেমন কোনো পরিকল্পনা করিনি। আপাতত এই ডকুফিল্মটি নিয়েই আছি। ইচ্ছে আছে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের।
জাগো নিউজ : আপনি তো লণ্ডনের বাসিন্দা। সেখানেই নিয়মিত থাকেন। সেক্ষেত্রে চলচ্চিত্র কী সেখানেই নির্মাণ করবেন? লিসা গাজী : যেখানে থেকেই নির্মাণ করি সেটা বাংলাদেশের জন্য বানাবো। আমি বীরাঙ্গনাদের এই কাজটির শুটিং করেছি বাংলাদেশের পাঁচটি অঞ্চল ও কলকাতায়। কাজটি কিন্তু করেছি বাংলাদেশের মানুষের জন্য।
জাগো নিউজ : ছবিটি নিয়ে দর্শকের উদ্দেশ্যে আপনার কোনো কথা? লিসা গাজী : ‘রাইজিং সাইলেন্স’ ডকুমেন্টারিটি প্রদর্শিত হবে আজ শুক্রবার (১৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যা ৭টায় পাবলিক লাইব্রেরিতে। ছবির টিকিট পাবলিক লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করা যাবে। টিকিটের মূল্য ৫০ টাকা। ছবি শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে থেকে টিকিট বুথ থেকে টিকিট সংগ্রহ করা যাবে।
মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের প্রতি নিজের দায়বোধ থেকে এই তথ্যচিত্রটি তৈরি করেছি আমি। এর টিকিট বিক্রির সকল অর্থ মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনা ও তাদের পরিবারকে প্রদান করা হবে। তাই যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করেন তাদের আহ্বান করছি ছবিটি দেখতে আসার জন্য।
এলএ/এমএবি/এমএস