টেলিমেডিসিনের হাত ধরে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামেও উন্নত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এ সেবা দিয়ে চলেছে চতরা ডিজিটাল স্বাস্থ্য কেন্দ্র। এতে নিজ এলাকায় অবস্থান করে স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন চতরাবাসী।
Advertisement
জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের পরিচালনায় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামের কারিগারি সহায়তায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে চতরা বাজার সংলগ্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় চতরা ডিজিটাল স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে উন্নত চিকিৎসা সেবা দিয়ে স্থানীয়দের আস্থা অর্জন করেছে ইন্টারনেট ভিত্তিক এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখন অসুস্থ ব্যক্তিরা জেলা বা উপজেলা শহরে না এসেও পাচ্ছেন উন্নত চিকিৎসা সেবা। বর্তমানে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বিভিন্ন রোগের ব্যবস্থাপত্র, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট প্রদান করা হয়। আর এসব কাজ হয়ে থাকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। শুক্রবার ব্যতিত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। ওই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কোনো রোগী ভর্তি হলে একজন অপারেটর তার রোগের বিষয়ে বিস্তারিত শুনে নোট করেন। এরপর কম্পিউটারের মাধ্যমে চিকিৎসকের সঙ্গে ভিডিওকলে যুক্ত হন অপারেটর। তিনি প্রথমে রোগীর যাবতীয় সমস্যাগুলো চিকিৎসককে পড়ে শোনান। পরে রোগীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা শুরু করেন চিকিৎসক। ভিডিও কলে রোগীর শারীরিক বিষয়গুলোও প্রত্যক্ষ করেন চিকিৎসক। পরে তিনি অনলাইনেই চিকিৎসাপত্র পাঠিয়ে দেন। আর সেই চিকিৎসাপত্র প্রিন্ট করে রোগীকে প্রদান করা হয়। আর ফি হিসেবে নতুন রোগীর কাছ থেকে দেড়শ টাকা এবং পুরাতন রোগীর কাছ থেকে একশ টাকা গ্রহণ করা হয়। যারা যাকাতভোগী তারা একটি আবেদন করলেই বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পেয়ে যান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকার প্রায় ৩০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অনলাইনের মাধ্যমে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা রোগীদের বিভিন্ন রোগের ব্যবস্থাপত্র প্রদান করে থাকেন। গতকাল সোমবার সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দেড় মাস বয়সী ফারিহার সমস্ত শরীরে ফুসকুড়ি উঠেছে। সঙ্গে বদহজমও ছিল। গত ৩ দিন থেকে মাত্রাতিরিক্ত কান্নাকাটি করছিল শিশুটি। সোমবার দুপুরে ফারিহাকে চতরা ডিজিটাল স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়ে আসেন তার মা খাদিজা বেগম। ডা. রাকিবুর রহমান সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে ফারিহার বিস্তারিত সমস্যা দেখেন ও সরাসরি ভিডিও কলে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত শোনেন এবং ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন। এর কিছুক্ষণ পর পেটের সমস্যার চিকিৎসার অগ্রগতি জানাতে আসেন স্থানীয় লেদমিস্ত্রি মাহফুজার রহমান (৩১)। তিনি জানান, এক বছর আগে এক রাতে হঠাৎ করে তার হাঁচি ওঠে এবং পেটে নাভির উপরে বাম পাশে ব্যথা শুরু হয়। পরের দিন স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শ নেন তিনি। এরপর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে সেবা নেন। এতেও সুস্থ না হওয়ায় তিনি রংপুরে কয়েকটি ক্লিনিকে সেবা নেন। এভাবে ৬ মাস কেটে গেলেও তার পেটের ব্যথা কমেনি। পরে তিনি চতরা ডিজিটাল স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এসে বিস্তারিত বললে চিকিৎসক তাকে ব্যবস্থাপত্র দেন। সেই ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খেয়ে বর্তমানে সুস্থ আছেন মাহফুজ। এরপর মুফিদ তাহমিদ নাবিল (৭), মিম (১৬) ও শহিদুল ইসলাম (৪৫) চোখের সমস্যার জন্য ডাক্তার রাকিবুর রহমানের পরামর্শ নেন। এদের মধ্যে দুইজনকে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে শহিদুলকে তার জটিলতার জন্য চক্ষু বিশেষজ্ঞকে দেখানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসক।
Advertisement
সেবা নিতে আসা চতরা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুন নূর মন্ডল বলেন, উপজেলা ও জেলা শহরে চিকিৎসা নিতে অতিরিক্ত অর্থ ও সময় ব্যয় হয়। অনেক মানুষ অর্থের অভাবে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যেতে পারেন না। এতে তারা জটিল রোগের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এখানে আমরা সময় ও অর্থ বাঁচিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে পারছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে স্থানীয় উদ্যোক্তা আল-আমীন মিয়া তার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও এলাকার সর্বসাধারণের সহযোগিতায় এ প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করেন। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে আল-আমীন মিয়া বলেন, বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম টেলিমেডিসিন কার্যক্রম শুরু করে। এর মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে প্রাথমিক পর্যায়েই একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে তারা জটিলতর পরিস্থিতিতে পড়ছেন না। তবে সেবা গ্রহিতার সংখ্যা খুব বেশি নয়। মানুষ এখনও অসচেতন। তারা রোগের চেয়ে দৈনন্দিন ব্যস্ততাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ফলে কঠিনতর অবস্থার আগে তারা কোনো লক্ষণকেই আমলে নেন না। টেলিমেডিসিন কার্যক্রমকে দ্রুত জনপ্রিয় ও সফল করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হলে প্রান্ত থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুচিকিৎসা পাওয়া সহজ হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জিতু কবীর/এমএএস/এমএস
Advertisement