নওগাঁ শহরের সোনাপট্টিতে দুই মাস আগে একটি স্বর্ণের দোকানে চুরি হয়। ইতোপূর্বে জেলার অন্যান্য উপজেলার স্বর্ণের দোকানে চুরির ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায়নি।
Advertisement
তবে এবারের চুরির ঘটনায় প্রশাসনের টনক নড়ে। সিসিটিভিতে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ ও অঞ্চলভিত্তিক কললিস্ট চেক এবং সোর্স কোনো কিছুই যেন কাজে আসছিল না।
এরপরও এমন একটি মামলা সম্পন্ন করেছেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আনাম। মামলাটির অনুসন্ধানের জন্য ঘুরতে হয়েছে ২১টি জেলা। এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত পাঁচজন চোর ও তিনজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে চুরি হওয়া ১১২ ভরি স্বর্ণ ও ৭ লাখ ৫৫ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
এ কাজের সার্বিক দিক-নির্দেশনায় ছিলেন সদর থানা পুলিশের ওসি আব্দুল হাই। সহযোগিতায় ছিলেন- এএসআই আহসান হাবীব ও আব্দুল মালেক এবং ডিএসবি কাইয়ুম খাঁন। রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় নওগাঁ পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
Advertisement
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নওগাঁর ব্যবসায়ী তৌফিকুল ইসলাম বাবু। শহরের সোনাপট্টিতে অবস্থিত তার দুটি স্বর্ণের দোকান ‘বাংলাদেশ জুয়েলার্স ও মেসার্স রুমি জুয়েলাস’। ঠাকুর ম্যানশন মার্কেটে অবস্থিত ‘মেসার্স রুমি জুয়েলার্স’ দোকানে গত বছরের ১-৩ নভেম্বর চুরি সংঘটিত হয়।
এই স্বর্ণের দোকানে চুরি করতে পাশের ‘আঁখি ইলেকট্রনিক’ দোকানের তালা খুলে ভেতরে ঢুকে চোরেরা। এরপর সিঁধ কেটে স্বর্ণের দোকানে ঢুকে। স্বর্ণের দোকানের চারটি সিন্দুকের দুটির তালা ভেঙে প্রায় ৫৯২ ভরি স্বর্ণ চুরি করা হয়; যার মূল্য প্রায় দুই কোটি ৬৯ লাখ ১০ হাজার ২২৫ টাকা।
এ ঘটনায় ৪ নভেম্বর থানায় অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় এসআই আব্দুল আনামকে। শুরু হয় ঘটনার রহস্য উন্মোচনের কাজ।
এসআই আব্দুল আনাম বলেন, সিসিটিভির ফুটেজ, অঞ্চলভিত্তিক কললিস্ট চেক এবং সোর্সের মাধ্যমে অনুসন্ধান কোনো কিছুই যখন কাজে আসল না, তখন কৌশল পরিবর্তন করলাম। অজানা উদ্দেশ্যে ঘুরতে শুরু করলাম। প্রথমে বগুড়া জেলা। তারপর নাটোর ও পাবনা জেলা। এরপর পর্যায়ক্রমে জয়পুরহাট, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা, মুন্সিগঞ্জ, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, নড়াইল, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ঢাকা ও বাগেরহাটসহ ২১টি জেলায় ঘুরেছি।
Advertisement
তিনি বলেন, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থানার মাটিভাঙ্গা গ্রামের একটি জঙ্গলে এক সপ্তাহ ধরে আত্মগোপনে ছিলাম একজনকে ধরার জন্য। সে অপারেশনে অবশ্য ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়। এরপর বাগেরহাটের শরণখোলা থানায় যাই। সেখানকার স্থানীয় কয়েকজনকে স্বপন ফরাজির (৪১) ছবি দেখানো হয়। স্বপন আন্তঃজেলা চোর হিসেবে পরিচিত। এই উপজেলার খোন্তাকাটা গ্রামে তার বাড়ি। পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বর্ণ চুরির কথা স্বীকার করে সহযোগীদের নাম বলে দেয় স্বপন।
তার তথ্যের ভিত্তিতে একই এলাকার ফজলুল হকের দুই ছেলে রুস্তম আলী (৫৭) ও আবুল কালামকে (৩৭) গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাদের ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। রুস্তমের কাছ থেকে স্বর্ণ বিক্রির ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা এবং ঢাকার কদমতলী থানার পূর্ব-জুরাইন বাজার ‘আল্পনা জুয়েলার্স’ থেকে ৩১ দশমিক ১১ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়।
এদের দুইজনের তথ্যের ভিত্তিতে তাদের সহযোগী পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থানার টিএনটি রোডের হানিফ হাওলাদার (২৬) ও গৌরিপুর গ্রামের ইউনুছ আলীকে (৩৫) গ্রেফতার করা হয়। সেই সঙ্গে ৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ও ৩ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। ঢাকার আরও তিন স্বর্ণ ব্যবসায়ী জামাল (৩৭), ইয়াকুব আলী (৩৬) ও সাগর আহমেদকে (৩৪) গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া জামালের কাছ থেকে ৭৮ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়।
এসআই আব্দুল আনাম বলেন, এই চুরি সংঘটিত করতে তারা দুইটি মোবাইল ব্যবহার করেছিল। একটি দোকানের ভেতরে এবং অপরটি বাইরে। তাদের চুরি সংঘটিত হওয়ার পর মোবাইল ফোন ও সিম ভেঙে ফেলা হয়েছিল। যার কারণে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। চোরেরা নামে-বেনামে একাধিক সিম ব্যবহার করে। বিষয়টি ছিল খুবই জটিল ও চ্যালেঞ্জের। প্রায় ২ মাস আটদিন পর এমনই একটি মামলার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।
নওগাঁর পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বলেন, চুরিটি এমনভাবে সংঘটিত হয়েছিল কোনো ক্লু আমরা পাচ্ছিলাম না। চোরদের গ্রেফতার করতে স্বর্ণ ব্যবসায়ী আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন। এছাড়া পুলিশ অফিসাররাও চেষ্টা করেছেন। যার কারণে দ্রুত আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে।
আব্বাস আলী/এএম/জেআইএম