ভ্রমণ

খুশির রাত, খুশির দিন

এর আগে প্রতিবারই দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা হয়েছে। এই প্রথমবার জাগো নিউজের ফ্যামিলি ডে রাত দিন মিলিয়ে। গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে শালবনের গহীনে দৃষ্টিনন্দন এক রিসোর্ট। সেই রিসোর্টে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই শুরু হবে ফ্যামিলি ডে। রাতে যাবো নাকি দিনে? এমন মধুর দোটানায় আমরা কজন। বিশেষ করে মেয়েরা। ছেলেরা তো এক পোশাকে বের হয়ে গেলেই হলো, কিন্তু মেয়েদের পোশাক, গয়না, মেকআপ, ছাতা, কম্বল আরো কত কী! একদিনের জন্য এতকিছু টেনে নিয়ে যাবো নাকি যাবো না। আবার শুরু হলো দোটানা। সপ্তাহখানেক ধরে দফায় দফায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে অবশেষে রাতেই যাওয়া চূড়ান্ত করলাম। রাতের গাড়ি ছেড়ে যাবে সন্ধ্যা সাতটায়। আমরা সেভাবেই তৈরি হয়ে এলাম। কিন্তু ছাড়লো আরও ঘণ্টাখানেক পর। আলোকচিত্রী বিপ্লবদা বৌদি, দুই বাচ্চা আর বিশাল লাগেজসহ আসতে গিয়েই দেরি করে ফেলেছেন! যাই হোক, অবশেষে গাড়ি ছাড়লো। গাড়িতে অ্যাডমিনের তানভীর ভাই পাঁচ টাকার ডালভাজা আমাদের কাছে বিশ টাকায় বিক্রি করলেন। কেউ টাকা দিলেন কেউ দিলেন না। তাই নিয়ে হইচই। এদিকে আরেক আলোকচিত্রী মাহবুব গান ধরলো তার সুরেলা গলায়। তার সদ্য কেনা গিটারে টুংটাং আওয়াজ আর তার কণ্ঠের যাদুতে সবাই তখন মুগ্ধ। গাড়িও ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যে।

Advertisement

রিসোর্টে যখন পৌঁছলাম তখন রাত এগারোটা। নেমেই মনে হলো, ভুল করে আমাদের গাড়ি কাশ্মীরে চলে আসেনি তো! শীতে সবার দাঁতে দাঁত লেগে যায় এমন অবস্থা! ঢাকায় এই মধ্য জানুয়ারিতে আমরা যারা শীতপোশাক ছাড়াই ঘুরে বেড়াই, রাজেন্দ্রপুরে গিয়ে তারাই লেপ, কম্বল, কাঁথা মুড়িয়ে ঘুরতে লাগলাম! রিসোর্টে গিয়ে দেখি মেয়েদের জন্য বরাদ্দ দুটি রুমের একটি আগেই দখল হয়ে গেছে! মেয়ের সংখ্যা কম মনে করে শেষ মুহূর্তে দুটি রুমের বদলে একটি বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু শিশু আর নারী মিলিয়ে বাড়তে বাড়তে সংখ্যাটি বারোয় গিয়ে ঠেকলো! একই রুমে কষ্টেসৃষ্টে আটজন পর্যন্ত থাকা যায়, কিন্তু বারোজন? অসম্ভব! তখন ফিচার বিভাগের ইনচার্জ আরমান ভাই পথ বাতলে দিলেন। সহকারী সম্পাদক হারুন ভাই তার পরিবার নিয়ে একটি রুমে আছেন। আমি, যুথী, নীলিমা আর সুমন ভাইয়ের স্ত্রী গিয়ে যেন হারুন ভাইকে উচ্ছেদ করে সেই রুমে অবস্থান নেই। যেই বলা, সেই কাজ! দ্রুত তিনতলা থেকে দোতলায় হারুন ভাইদের রুমে গিয়ে দেখলাম সেখানে কেউ নেই। অমনি আমরা দুটি বিছানা থেকে ম্যাট্রেস নামিয়ে ফ্লোরে বিছানা পেতে ফেললাম। সিঙেল খাট দুটি ঠেলে এক জায়গায় নিয়ে ডাবল খাট বানিয়ে দিলাম! এই কাজ করতে গিয়ে আমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি। কারণ যুথী তখন বলছিল, যাদের রুম তাদের খবর নেই, এদিকে আমরা এসে দখল নিয়ে নিলাম। এমন ডাকাতি আমি আমার বাপের জন্মেও করিনি! রুম দখলের আগে অবশ্য আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। হাড় কাঁপানো শীতে রাত বারোটায় লাইনে দাঁড়িয়ে গরম গরম খিচুড়ি, ডিম ভুনা আর জলপাইয়ের আচার নিলাম।

Advertisement

রাত একটা পর্যন্ত গল্প আর আড্ডা ভালোই চললো। হারুন ভাইয়ের স্ত্রী, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার ভাইয়ের স্ত্রী, তাদের সন্তানেরা আর আমরা মিলে গল্প করছিলাম। গল্প শেষে ঘুমিয়ে পড়বো ভেবে বিছানা ঠিক করতে নিয়েছি এমন সময় পানির বোতল হাতে দরজায় এলেন মহিউদ্দিন ভাই। বললেন, ‘যেই ঘুমাতে যাবে তাকেই পানি ছিটিয়ে উঠিয়ে দেয়া হবে।’ নিচে অতিথি শিল্পীদের গানের আসর হচ্ছে সেইসঙ্গে বার্বিকিউ পার্টি। এমন আয়োজন যে মিস করবে তাকে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে দেয়ার প্রশ্নই আসে না! অগত্যা আবার আগাগোড়া কম্বলে আবৃত হয়ে নিচে এসে গানের আসরে যোগ দিলাম। বাউলশিল্পী সাগর দেওয়ান, বীথি ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রশিল্পী তো ছিলেনই, সেইসঙ্গে যোগ দিলেন আমাদের আলোকচিত্রী মাহবুব আলম, নিজস্ব প্রতিবেদক মাসুম আওয়াল, মহিউদ্দিন ভাইয়ের মেয়ে রোহা, এবং বিপ্লবদার স্ত্রী। প্রত্যেকেই বেশ সুন্দর কিছু গান শোনালেন। এত সুন্দর গানের আয়োজনের জন্য জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু ভাই একটি ধন্যবাদ পেতেই পারেন। গান শেষে চিকেন বার্বিকিউ খেয়ে যখন রুমে ফিরলাম ততক্ষণে রাত তিনটা বেজে ত্রিশ! ঘুমাতে ঘুমাতে বেজে গেল চারটা! হারুন ভাইয়ের রুম দখল করে আমরা আরামে ঘুমালাম আর বেচারা হারুন ভাই সারারাত না ঘুমিয়ে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ালেন!

চারটায় ঘুমিয়ে আমাদের ঘুম ভাঙলো সকাল আটটায়। ঝটপট তৈরি হয়ে নিচে নেমে এলাম। হিমহিম কুয়াশা আর মিঠে রোদ্দুরের মিতালি দেখে সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। এই কনকনে শীতেও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জিয়াউল হকের নেতৃত্বে সুইমিংপুল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই। সকালের নাস্তায় খেলাম লুচি, চিকেন-আলুর দম আর সুজি-গাজরের হালুয়া। তারপরে ছিল খেজুরের রস। খাওয়া শেষে একটুখানি ঘোরঘুরি করে, অল্পকিছু ছবি তুলে আবার রুমের দিকে ছুটলাম। যার যার নতুন জামাকাপড় পরে যত দ্রুত সম্ভব তৈরি হয়ে বের হলাম। তৈরি হতে গিয়ে ছেলেবেলার ঈদের দিনটির কথা মনে পড়ছিল বারবার। তখনও এমন শীতের সকালে সুন্দর জামাকাপড় পরে ঘুরতে বের হতাম।

Advertisement

বের হয়ে দেখি সকালের গাড়িও চলে এসেছে। সকালে গাড়ি ছিল দুটি। দুই গাড়ি ভর্তি আমাদের জাগো নিউজ পরিবারের বাকি সদস্যরা এসে গেছেন। তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প, ছবি তোলার পরে আমরা ছোট একটি দল জঙ্গলে ঘুরতে গেলাম। দল বলতে আমি-আমার বর, যুথী-যুথীর বর, সুমন-সুমনের স্ত্রী আর নীলিমা। বনের ভেতর কোনো সুন্দর জায়গা দেখলেই আমরা দৌড়ে গিয়ে ছবি তুলি। এমন করে পুরো পথেই ছবি তুলতে তুলতে হাঁটলাম। হাঁটতে হাঁটতে যখন পথ শেষ হলো, দেখলাম ঘুরেফিরে আমরা রিসোর্টের সামনেই চলে এসেছি! ততক্ষণে আজান হয়ে গেছে। ছেলেরা জুমার নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে গেলো। আর আমরা মেয়েরা আবার রিসোর্টে চলে এলাম। আমাদের ঘোরাঘুরির ফাঁকেই ছেলেদের প্রীতি ফুটবল ম্যাচ, শিশুদের দৌড় প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফুটবল খেলায় প্রধান প্রতিবেদক মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল ভাইয়ের দল জয়লাভ করে। খেলা পরিচালনায় ছিলেন ওয়েব ইনচার্জ হাসিবুল হাসান আশিক ভাই, সহ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিথুন ও আরেক সহ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ভাই।

নামাজের শেষে দুপুরের খাবারের পালা। আবার সুশৃঙ্ক্ষলভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিলাম। জিভে জল আনা কাচ্চি বিরিয়ানি যেখানে কিশমিশ বাদাম আর আলুবোখারা জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে, কাবাব, চিকেন রোস্ট, সালাদ আর লাচ্ছি নিয়ে দেরি না করে খাবার টেবিলে বসে গেলাম। মজার সব খাবারের জন্য সুভাষ দেবকে ধন্যবাদ না জানালে কার্পণ্য করা হবে। খাওয়া শেষে সবাই একটু জিরিয়ে নিলেন। এরপরই শুরু হলো টিপ পরানো খেলা। যে যার স্ত্রীকে টিপ পরাতে হবে। প্রতিযোগীর চোখ থাকবে বাঁধা। সে এক জটিল খেলা। একটু ভুল হলেই নিজের বউ রেখে আরেকজনের বউকে টিপ পরানোর ভয়! সেই অগ্নিপরীক্ষায় পাস করলেন তিনজন- তানভীর ভাই, সহ সম্পাদক সেলিম ভাই, আর সহ সম্পাদক রুহুল আমিন রয়েল ভাই।

শেষ পর্বে ছিল র‌্যাফেল ড্র আর পুরস্কার বিতরণী। নব বিবাহিতদের পুরস্কার, সেরা পারফর্মারদের পুরস্কার, আর র‌্যাফেল ড্রয়ের বিজয়ীদের পুরস্কার দেয়া হলো। র‌্যাফেল ড্রয়ে বরাবরের মতোই এবারও কোনো পুরস্কার পেলাম না। তবে সবার আনন্দে আমরাও যোগ দিলাম। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিজয়ী বিমানের টিকিট পেয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লেন। সঙ্গে তাল মেলালাম আমরাও। র‌্যাফেল ড্রয়ের বিশটি পুরস্কার ছাড়াও সবার জন্য কমন উপহার ছিল ভিশনের সৌজন্যে একটি করে ইলেক্ট্রিক কেটলি। এরপর ফেরার পালা। রুমে এসে যার যার ব্যাগ-বোচকা গুছিয়ে নিলাম। গাড়ি ছাড়লো ঠিক সময়েই। ঠিক সন্ধ্যায়, দিনের আলো যখন মিলিয়ে আসছিল আমরা তখন শালবনের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি। হইচই আর আনন্দে কেটে গেল একটি খুশির রাত, খুশির দিন। আবারও নাগরিক ব্যস্ততায় ফিরে আসা। নিয়নের লাল-নীল বাতির শহরে তখন তীব্র যানজট। গাড়ির জানালা খুলে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস নিলাম। মাহবুব তখনও তার সদ্য কেনা গিটারে টুংটাং শব্দ তুলে গেয়ে চলেছে, ‘আগে যদি জানতাম, তবে মন ফিরে চাইতাম, এই জ্বালা আর প্রাণে সহে না...।’

এইচএন/পিআর