মতামত

ড. কামালের ভুল স্বীকার এবং বিএনপি

 

ভুল- আমাদের রাজনৈতিক সমাজে অপরিচিত শব্দ। সমালোচনা তাদের কাছে অসহ্য। সেই সমাজের কেউ যদি তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ভুল স্বীকার করেন; সেটা বিরল ঘটনা মনে হয়। তখন খানিকটা আশাবাদী হয়ে বলা যেতে পারে; যাক; আমাদের রাজনীতিবিদরা ভুল স্বীকার করতে শিখেছেন!

Advertisement

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন নির্বাচন পরবর্তী সময়ে এসে বলেছেন জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে একই প্রতীকে নির্বাচন করা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। সেই ভুল বুঝতে তাঁর একটা বেশি সময় লেগে গেল কী? তারপরও তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হবে; স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সাথে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করা ভুল ছিল সেটা তিনি উপলব্ধি করছেন। তবে তিনি উপলব্ধি করলেন। তাঁর দলের অন্যরা উপলব্ধি করলেন। কিন্তু তাঁর ফ্রন্ট সঙ্গী অন্যান্যরা কী সেটা স্বীকার করবেন? এই প্রশ্নটা ড. কামাল হোসেন সামনে এগিয়ে দিয়েছেন।

জামায়াত ২০ দলীয় জোটে বিএনপির সঙ্গী। মূলতঃ সেই জোটটার নেতৃত্বে বিএনপি। তারা কী উপলব্ধি করছেন সেটা এখনো জানা যায়নি। তবে অতীত বলছে; বিএনপির পক্ষে জামায়াত ছাড়া অসম্ভব না হলেও কঠিন। বরং জামায়াতের পক্ষে এখন সহজ বিএনপিকে ছেড়ে যাওয়া। জামায়াতেকে সংগে রেখে গত দশ বছরে বিএনপির যে অবস্থা, তাতে জামায়াত এখন বিএনপির সঙ্গী হতে চাইবে কী না সেটাও বড় এক প্রশ্ন।

তাছাড়া জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষৎ কী- তা নিয়েও রাজনীতি সমাজে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। নিষিদ্ধ হতে পারে জামায়াতের রাজনীতি। তাতে জামায়াতের নেতারা নতুন দল গড়বেন না কি বিএনপিতে অনানুষ্ঠানিক যোগ দান করবেন সেটা এখনই বলা যায় না।

Advertisement

বিএনপিকে এখন ফ্রন্ট সংগী হিসেবে চায় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন। অথবা তাঁর গণফোরাম। তবে সেই ঐক্যে জামায়াতকে তারা চান না। সেটা পরিস্কার করে বলেছেন। তা হলে কী আগামীতে বিএনপির সংগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সম্পর্কটা কী হতে যাচ্ছে, তার বড় একটা ইস্যু হতে যাচ্ছে ‘জামায়াত’?

পরোক্ষভাবে গণফোরাম বিএনপিকে একটা শর্ত দিয়ে দিল কী, ঐক্যফ্রন্টে থাকতে হলে জামায়াতকে ছাড়তে হবে? সিদ্ধান্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের দেশে বসে নেয়ার ক্ষমতা নেই। তাদের সিদ্ধান্ত আসবে লন্ডন থেকে। লন্ডনের সিদ্ধান্ত- জামায়াতকে ছাড়া বিএনপি রাজনীতি করবে এমন হবে; তা ভাবা কঠিন। কারণ, এরকম সিদ্ধান্ত নেয়ার সহজ সুযোগ বিএনপির সামনে এসেছিল নির্বাচনের সময়। যখন, ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলেছিলেন; স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়ে কোন ঐক্য নয়। বৃহত্তর ঐক্য এবং আগামী দিনের রাজনীতির কথা মাথায় রেখে জামায়াতকে ছাড়ার সিদ্ধান্তটা সেই সময়ই নিতে পারত বিএনপি। কিন্তু তারা নেয়নি।

সে সময় অবশ্য ড. কামাল হোসেনদের কণ্ঠেও আর জামায়াত সম্পর্কে খুব জোরেশোরে কিছু শোনা যায়নি। চাপটা সে সময় তারা বিএনপিকে দেয়নি। তারাও কি জামায়াতের ভোটের আশায় ছিলেন? ধানের শীষে জামায়াতী ভোট পড়লে তারা জিতে যাবেন হয়তো এরকম কোন গাণিতিক হিসাব তারা মেলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই হিসাব মেলেনি। আর সেই হিসেবে গণ্ডগোল হওয়ার বড় একটা ফ্যাক্টও হতে পারে জামায়াত। সেটা বুঝতে পেরে ড. কামাল সাহেবরা এখন বলছেন, জামায়াত ছাড়া জাতীয় ঐক্য চান তারা।

কিন্তু সেরকম ঐক্যে বিএনপির যদি সায় না থাকে, তাহলে কী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারটা গুটিয়ে ফেলা হবে? তেমন কোন আভাস কিন্তু গণফোরাম নেতারা দেননি। রাজনীতি বিশ্লেষক না হয়েও ঝুঁকিপূর্ণ একটা মন্তব্য করে ফেলা যায়; বিএনপি জামায়াত সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার না করলে গণতন্ত্রের জন্য একটা শাপে বর হতে পারে।

Advertisement

গণফোরাম থেকে যে দুইজন প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরা গণতন্ত্রের স্বার্থে শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দিতে পারবেন। অন্তত মুখ রক্ষার জন্য হলেও বলতে পারবেন; বিএনপি তো জামায়াত ছাড়েনি। আমরা কেন তাদের জন্য সংসদে আমাদের প্রতিনিধিত্ব হারাবো? গণফোরামের দুজন যদি সংসদে যোগ দেন, নিজেদের কথাগুলো সুযোগ পেয়ে বলেন, তাতে লাভ তাদের হবে। সেটা গণতন্ত্রের জন্য ভাল।

ড. কামাল হোসেন ভুল বুঝতে পারছেন। কিন্তু বিএনপি ভুল জেনেও সেটা মুখে বলতে পারছে না! এটাই তাদের রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি। তবে রাজনীতি কেন, ব্যক্তি জীবনেও ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হয়। সেই শিক্ষা নিতে বিএনপি যদি আবারও ভুল করে সেটা তাদের জন্য বড় ভুল হয়ে দেখা দিতে পারে আগামীতে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপির সংসদে আসা উচিত। ঠিক আছে প্রধানমন্ত্রীর কথা বিএনপির শোনার দরকার নেই। গণতন্ত্রের স্বার্থও তাদের দেখার দরকার নেই। বিএনপির নিজেদের স্বার্থেই সংসদে যাওয়া উচিত।

সংসদ নির্বাচন বর্জন করে ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত নিজেদের রুগ্ন চেহারা প্রতিদিন তারা দেখেছেন। এবার ফল বর্জন করে সেই রুগ্ন চেহারাকে আরো ক্ষয়িষ্ণু না করাই ভাল। দশম জাতীয় সংসদ বর্জন ছিল বিএনপির রাজনীতিতে ঐতিহাসিক ভুল। এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল বর্জন করে আরো বড় ভুলের দিকে না হাঁটাই ভাল। রাজনীতিতে কোনদিন কারো জন্য জায়গা ফাঁকা থাকে না। সেটা বিএনপি নেতারা ভাল করেই জানেন।

ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছে। কিন্তু একটু অতীত আশ্রয়ী হলে বিএনপি ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাবে; দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে ক্ষমতায় থেকে দল গঠন করে বিএনপি নির্বাচন করেছিল। তারপরও সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ৩৯ টি আসন পেয়েছিল। সেখানে বিশাল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়েও শাহ আজিজের মত বিএনপি নেতারা কিন্তু মহিউদ্দিন আহমেদ, সুধাংশু শেখর হালদারদের যুক্তিবাণে জর্জরিত হয়েছিলেন। সেই আওয়ামী লীগ সংসদ-সংসদের বাইরে আন্দোলন করে ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসেছিল। এরপর আবার টানা দশবছর ক্ষমতায় তারা। সেটা টানা পনের বছরই হবে।

অন্যের কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ খুঁজলে ভুল হবে। নিজের দল, নেতা-কর্মীদের নিয়েই বিএনপির রাজনীতি করা উচিত। জামায়াত- যারা এই দেশটার জন্মের-ই বিরোধিতা করেছে, তারা আর যাই হোক বিএনপির জন্য দিনে দিনে বোঝা হয়ে দাঁড়াছে। বিএনপির অনেক নেতাকর্মী সেটা বুঝতে পারছেন। কিন্তু মুখে বলতে পারছেন না। ড. কামাল ভুল স্বীকার করে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকে কথা বলার রাস্তাটা বাতলে দিলেন কী!

লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস