মালয়েশিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায়ই বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রাণ হারাচ্ছেন। কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করার পর নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবিদার হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো যুগ পোরোলেও সেই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য তাদের অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না।
Advertisement
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূতাবাস ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলো যথাযথ ভূমিকা রাখছে না। প্রবাসে মৃত্যুজনিত কারণে ক্ষতিপূরণের অপেক্ষায় আছে শত শত পরিবার। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন অনেকে।
এদিকে মালয়েশিয়ায় গত এক বছরে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৭৮ হাজার ২২৫ টাকার ক্ষতিপূরণ আদায় করেছে দূতাবাস। তবে সেদেশে বাংলাদেশিরা কর্মরত অবস্থায় বকেয়া, দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও ইন্স্যুরেন্সের ক্ষতিপূরণ আদায়ে দূতাবাসের সক্রিয় আইনি সহায়তায় এ ক্ষতিপূরণ আদায় করতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রশাসনিক ধীরগতি ও হয়রানিসহ নানা কারণে বেশিরভাগ শ্রমিকের পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
তিন বছর অতিবাহিত হলেও ক্ষতিপূরণ পায়নি বরিশালের মৃত ফজলু দফাদারের পরিবার। অভিযোগ উঠেছে দফায় দফায় প্রবাসী কল্যাণ অফিসে ধর্ণা দিয়েও ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছেন না মৃতের পরিবার।
Advertisement
অভিযোগে জানা যায়, বরিশাল সদরের চরবুখাই নগর গ্রামের আছমত আলী দফাদারের ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী মৃত ফজলু দফাদার পাসপোর্ট নং (এফ-০৪৭৬৩৬৫) সিল নং-১২, ক্লেইম নং-৯৬/২০/৬, তারিখ: ০৭/১১/২০১৭, তার মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ বাবদ হাইকমিশন থেকে মৃতের স্ত্রী চার কন্যার নামে পাঁচটি ড্রাফ্ট প্রেরণ করা হয়।
মৃতের পরিবার ডিইএমও বরিশাল থেকে ড্রাফ্ট গ্রহণের পর বরিশালের বিভিন্ন ব্যাংকে ড্রাফ্ট জমা দিতে গেলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানান, ড্রাফ্টগুলো ভাঙানো যাবে না। পরবর্তীতে মৃত ফজলু দফাদারের পরিবার ঢাকার ডাচ-বাংলা ব্যাংক, শান্তিনগর শাখায় জমা প্রদান করতে গেলে ড্রাফটের মেয়াদ শেষ হয়েছে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানান।
ফলে মৃতের স্ত্রী শাহানুরের নামে একক চেক পাওয়ার জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নিসহ মূল ড্রাফ্ট পাঁচটি ডিইএমওর মাধ্যমে হাইকমিশনে শ্রম কাউন্সিলরে ফেরত পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত দূতাবাস ক্ষতিপূরণের সুরাহা করতে পারেনি বলে এ প্রতিবেদককে মোবাইল ফোনে জানান মৃত ফজলু দফাদারের স্ত্রী শাহানুর।
এ বিষয়ে দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলে শ্রম শাখার কর্মকর্তা জানান, ক্ষতিপূরণের চেক সময় মতো তারা ব্যাংকে জমা না করায় এ সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সমাধানের।
Advertisement
দূতাবাস সূত্র জানায়, হাইকমিশনার শহীদুল ইসলামের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ও তার সার্বিক দিক-নির্দেশনায় আইনি সহায়তায় দুর্ঘটনা, বকেয়া বেতন, মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ আদায় বাবদ নিয়মিত চেক দূতাবাস থেকে পাঠানো হলেও বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাশিত ব্যক্তিদের নিকট হস্তান্তরে সময় শেষ হয়ে যায়। ফলে চেকটি নগদায়নে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
চেকটি পুনরায় মালয়েশিয়াতে ফেরত পাঠানো হয় এবং নতুন করে মালয়েশিয়ার শ্রম অফিসের মাধ্যমে পেতে অনেক সময় লাগে। শুধু তাই নয়, সে দেশের শ্রম অফিসের কর্মকর্তারা মনোক্ষুণ্ন হন। এ অবস্থায় ক্ষতিপূরণ প্রত্যাশীরা একের পর এক দায়-দেনার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।
এ বিষয়ে দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর, অতিরিক্ত সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনা, মৃত্যু বা বকেয়া বেতন ও শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আদায়ে আইনি প্রক্রিয়ায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
এ ছাড়া, যাদের বৈধতা রয়েছে এবং কাগজপত্র সঠিক তারাই ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর এই ক্ষতিপূরণ আদায়ে দূতাবাস সর্বাত্মক সহযোগিতা করে থাকে। বাংলাদেশি কর্মীরা ক্ষতিপূরণ পেতে যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হয় তার জন্য সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১০ বছরে মোট ৩ হাজার ৫৭টি মরদেহ দেশে ফিরেছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া থেকে গত এক বছরে এসেছে ৭৮৪ জনের মরদেহ। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে নিহতদের পরিবার আইনানুগভাবেই ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবিদার হন।
এ বিষয়ে মালয়া ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক মো. খালেদ শুকরান বলেন, ‘বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পর মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ আদায় একটি আন্তরাষ্ট্রিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই এখানে সরকারেরই মুখ্য ভূমিকা নিতে হয়। বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের সন্তান।’
তিনি বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তারা জমিজমা বিক্রি কিংবা ধার-দেনা করে বিদেশে পাড়ি জমান। এ অবস্থায় দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু হলে তার পরিবার অসহায় বোধ করবে এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশি স্কলার ইউনিভার্সিটি তেনাগা ন্যাশনাণ মালয়েশিয়ার প্রফেসর ড. নওশাদ আমিন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিদেশে কোনো বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা লাশ দেশে আসার অপেক্ষায় প্রহর গোনা শুরু করেন। লাশ পাওয়ার পর দাফন শেষে তাদের প্রতীক্ষা থাকে কবে ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়া যাবে। দুঃখজনক হলো, নিহত পরিবারে ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার প্রতীক্ষা তাদের আর শেষ হয় না।’
তিনি বলেন, ‘এটা সত্য যে, বিদেশে কর্মক্ষেত্রে নিহত বাংলাদেশিদের কিছু সংখ্যকের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ আদায়ে জটিলতাও তৈরি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, এক কোম্পানি থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় অবৈধভাবে কাজ করার সময় দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে আগের কোম্পানি ক্ষতিপূরণ দেয় না। এসব জটিলতা এড়াতে বাংলাদেশ থেকে কেউ যাতে অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি না জমায়, সেদিকে সরকারের মনোযোগ বাড়াতে হবে। তবে যারা আইনানুগভাবে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবিদার তাদের ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা কোনো অজুহাত দিয়ে ঢাকা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘এমন উদাহরণ রয়েছে বিদেশের আদালত নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য আদেশ দিয়েছেন তারপর সেই ক্ষতিপূরণ হাতে পাওয়া যাচ্ছে না।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করতে সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসকে মূল ভূমিকা পালন করতে হয়। এক্ষেত্রে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা আর উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে। এসব খতিয়ে দেখা দরকার সরকারের।’
মানবাধিকার কর্মী হারুন আল-রশিদ বলেন, ‘বিদেশ বিভুঁইয়ে শ্রম বিক্রি করে দেশে রেমিটেন্স পাঠানো শ্রমিকের দুঃখজনক মৃত্যুর পর তার পরিবারের পাওনা ক্ষতিপূরণ আদায়ে দায় রয়েছে সরকারের। আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ীও অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। সরকার রেমিটেন্স যোদ্ধাদের গোল্ডেন বয় উপাধি দিলেও দেশে কয়েক হাজার পরিবার বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষার অনিশ্চিত প্রহর গুনবে- এটা স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া যায় না। বিদেশে কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়টিতে সরকারের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে এই প্রত্যাশা আমাদের।’
এমআরএম/এমএস