নাজমুন নাহার এখন পর্যন্ত ছুঁয়েছেন ১২৩টি দেশের সীমানা। সোমবার পৌঁছান পশ্চিম আফ্রিকার শেষ প্রান্তের ছোট্ট দেশ বেনিনে। আর মাত্র দুটো দেশ অতিক্রম করলেই পূর্ণ হবে তার ভ্রমণের আরেকটি মাইলফলক। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম পতাকাবাহী যিনি দেশ ভ্রমণের মাধ্যমে বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন। তার এই ভ্রমণ যাত্রার মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকা ছোঁবে জাতিসংঘ অন্তর্ভুক্ত বিশ্বের প্রতিটি দেশে।
Advertisement
জানা গেছে, ঘানা থেকে টোগো হয়েই তিনি বেনিনে পৌঁছান। বেনিনের পোর্ট নোভো রাজধানী শহর থেকেই নাইজার হয়ে পৌঁছান নাইজেরিয়ায়। পশ্চিম আফ্রিকার প্রতিটি দেশে তিনি সড়ক পথে ভ্রমণ করেছেন। তার এই দুর্দান্ত যাত্রা খুব একটা সহজ ছিল না।
কোনো বাধাই তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। লাল সবুজের পতাকা হাতে সাহারার তপ্ত মরু থেকে শুরু করে সমুদ্রের তলদেশ, পর্বত শৃঙ্গ, শহর, বন্দর, আফ্রিকার দুর্গম জঙ্গল সব জায়গায় যার পদচিহ্ন পড়ছে একে একে।
কঠিনকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের এই নারী সম্প্রতি কয়েক হাজার মাইল সড়ক পাড়ি দিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার সব কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করে এক অনন্য মাইল ফলক গড়েছেন। তার ভ্রমণ তালিকায় যুক্ত হয়েছে আবারও ১৫টি দেশের নাম।
Advertisement
সাহারা মরুভূমি ও উত্তর আটলান্টিকের পাশ ঘেঁষে যাওয়া সব দেশগুলো ভ্রমণের জন্য যেভাবে ম্যাপ করেছেন নাজমুন ঠিক সেভাবেই পাড়ি দিয়েছেন।
নাজমুন নাহার মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, গাম্বিয়া, মালি, গিনি বিসাও, গিনি কোনাক্রি, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, বুরকিনা ফাসো, নাইজার, নাইজেরিয়া, ঘানা, টগো, বেনিন ভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রের সবচেয়ে কঠিন পথ অতিক্রম করেছেন।
নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত গত তিন মাস ভ্রমণের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং মুহূর্তের মোকাবেলা করেন পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে। পাশাপাশি তিনি তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকাকে পরিচয় করিয়ে দেন। এ ছাড়াও পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে তিনি স্কুল, কলেজ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে বিশ্ব শান্তির বার্তা পৌঁছিয়ে দেন, বলছিলেন নাহার।
বাংলাদেশের পতাকা হাতে তার এই দুর্বার দেশ জয় কতটা কঠিন ও বিপদসংকুল অভিযাত্রা ছিল তা নিয়েই নাহার বলেন, ‘যা কঠিন তা সুন্দর। পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণের সময়ও আমি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। মৃত্যুকে জয় করে আজ আমার বেঁচে থাকা। এই মৃত্যুঞ্জয়ী আমি অন্যান্য সব দেশ ভ্রমণের স্বপ্ন দেখছি এখনো।’
Advertisement
আরও পড়ুন> ১১৪ দেশের সীমানায় নাহারের ভালোবাসা
তিনি বলেন, ‘পশ্চিম আফ্রিকার পথে পথে আমাকে অনেক কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু আমি সবই আমার মানসিক শক্তি আর পজিটিভ চিন্তা দিয়ে মোকাবেলা করেছি।’
কঠিন পথ সাধ্য করেছেন নাজমুন। বলা চলে হার না মানা বাংলাদেশের এই সাহসী নারী।
‘বাংলাদেশের লাল সবুজের এই পতাকা আমার কাছে সবচেয়ে বড় শক্তি। এই পতাকা আমাকে ছায়া দিয়েছে অনেক। বাংলাদেশের পতাকা হাতে যখনি আমি নতুন কোনো দেশের সীমান্তে পা দিয়েছি তখনই আমার সঙ্গে যেন জেগে উঠেছে ১৬ কোটি প্রাণ।’
বিশ্ব মানচিত্রের সবচেয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছেন নাজমুন নাহার। জানান, মৌরিতানিয়ার সাহারা মরুভূমিতে তপ্ত মরুঝড়ে আক্রান্ত হয়ে ধারাল বালির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি। সেনেগালের রোজ লেকে যাওয়ার পথে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পথ হারিয়ে তিন ঘণ্টা জঙ্গলে হাঁটার পর অচেনা গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় পথ খুঁজে পাই।
তিনি বলেন, ‘সেন্ট লুইতে একাকী পথ হারিয়ে আট কিলোমিটার পায়ে হেঁটে অন্ধকার পথ পাড়ি দিয়ে এক ভয়ানক পরিস্থিতি অতিক্রম করে আবু নামক এক যুবকের সহযোগিতায় বাস স্টেশন খুঁজে পাই।’
গিনি কোনাক্রিতে যাওয়ার পথে মধ্যরাতের অন্ধকারে আঠারো ঘণ্টা জঙ্গল পথে আটকে থাকা এক বিভীষিকাময় রাতকে হার মানিয়েছে।
বলেন, ‘কোনাক্রিতে পৌঁছার পর লোকাল ফ্যামিলির সঙ্গে থাকার সময় প্রচণ্ড গরমে মধ্যরাতে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো অবস্থা হয়। সেই রাতে আমি আরেকবার মৃত্যু পথ থেকে বেঁচে উঠেছি। গিনি থেকে সিয়েরা লিওনের বর্ডার অতিক্রম করার জন্য যখনি বর্ডারে পৌঁছালাম তার কিছুক্ষণ আগেই বর্ডার বন্ধ হয়ে যায়। বর্ডার ক্রস করতে না পেরে ইমিগ্রেশন অফিসারের সহযোগিতায় আমি একটি গেস্ট হাউসে উঠি।’
আরও পড়ুন> বিজয় দিবসে বিশ্বজয়ীর লাইবেরিয়া জয় আরও জানান, বর্ডারের পাশের সেই ছোট্ট টাউনে কোনো ইলেকট্রিসিটি নেই। অন্ধকার আর জঙ্গলে ভরা গিনির ওই বর্ডার এলাকার গ্রামটি ছিল যেন এক ভুতুড়ে গ্রাম।’
‘সিয়েরা লিওন থেকে লাইবেরিয়া আসার সময় সারা পথে ১১টি ভয়ঙ্কর কূপ পার হতে হয়েছিল। এ ছাড়া সেখানে বিকল্প কোনো পথ ছিল না। শুধু তাই নয়, রাস্তা কোথাও ভয়ঙ্কর উঁচু, কোথাও পিচ্ছিল, কোথাও ভয়ানক ধুলোমাখা, কোথাও রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ডাল পালা সরিয়ে আসতে হয়েছিল, বাইক ছাড়া ওই সব রাস্তা পার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না বলেও জানান নাহার।
‘সিয়েরা লিওনের বউ শহর থেকে বর্ডার শহর জেন্ডামা পর্যন্ত প্রায় ৬ ঘণ্টার এই পথের স্মৃতি আমার ভ্রমণ যাত্রার ইতিহাসে একটু ভিন্ন অভিজ্ঞতা দিলো। বার বার মনে হচ্ছিল আমি যেন মাসুদ রানার সেই বইয়ের থ্রিলের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম।’
তিনি একে একে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন বিস্ময়, ফেরি করছেন বাংলাদেশের পতাকা। সকল বাধা, ভয়-শঙ্কা, মৃত্যুসহ সব পিছুটান দু’পায়ে দলে দুর্বার আকর্ষণে নদী, সাগর, পাহাড়, উপত্যকার বাধাকে উপেক্ষা করে ছিনিয়ে এনেছেন কাঙ্ক্ষিত বিজয়, লাল সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন দিগন্তজুড়ে। পেয়েছেন ‘ফ্লাগ গার্ল’ উপাধি।
২০০০ সালে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে তার প্রথম বিশ্বভ্রমণ শুরু হয়। সে সময় তিনি ভারতের ভুপালের পাঁচমারিতে যান। এটিই তার জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমন। বিশ্বের ৮০টি দেশের ছেলে-মেয়ের সামনে তখন তিনি প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সেই থেকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে তার বিশ্ব যাত্রার শুরু।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ৯৩তম দেশ হিসেবে ভ্রমণ করেছেন নিউজিল্যান্ড। ২০১৮ সালের ১ লা জুন নাজমুন ১০০ দেশ ভ্রমণের মাইলফলক সৃষ্টি করেন পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়েতে। তিনি বাংলাদেশের পতাকা হাতে জাম্বিয়ার সীমান্তবর্তী লিভিংস্টোন শহরে অবস্থিত পৃথিবীর বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের ব্রিজের ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে জিম্বাবুয়েতে পৌঁছান।
ইতিহাসে তার শততম দেশ ভ্রমণের সাক্ষী হয়ে রইলো এই ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। যে জলপ্রপাতটির অর্ধেক বহমান জাম্বিয়ায়, বাকি অর্ধেক বহমান রয়েছে জিম্বাবুয়েতে। ২০১৮ সালে তিনি পৃথিবীর মানচিত্রের ৩২টি দেশ সফর করেছেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে নাজমুনের মতো এমন নারী বিরল যিনি এক দেশ থেকে আরেক দেশে হাজার হাজার মাইল বাই রোডে একা একা ভ্রমণ করছেন নিজ দেশের পতাকা হাতে। দিনে রাতের অন্ধকারকে একাকার করে পর্বতে, সমুদ্রের তলদেশে, দুর্গম জঙ্গলে, বন্যপ্রাণীর পাহাড়ে, অজানা আদিবাসীদের এলাকায় কোথাও যেতে ভয় পায়নি এই নারী।
এমআরএম/এমএস