ফিচার

শীতের হাওয়া লাগল প্রাণে

সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা অপরূপ বাংলাদেশ। বলা হয় ষড়ঋতুর দেশ। এই ঋতুবৈচিত্র বাংলাদেশকে সাজিয়ে তোলে বিচিত্র রঙের সাজে। ঋতুচক্রে হেমন্তকালের পরই প্রকৃতি ঘন কুয়াশায় মুখ ঢেকে উত্তরের হাওয়া নিয়ে ধরণীর মাঝে উপস্থিত হয় শীতকাল। শীতের বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে লিখেছেন মরিয়ম আক্তার-

Advertisement

শীতকাল জড়তা বা রিক্ততার প্রতীক হলেও এর রয়েছে এক ঐশ্বর্যরূপ। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, পৌষ ও মাঘ মাস শীতকাল। শীতের সকালে এক অপরূপ সৌন্দর্যে বাংলার প্রকৃতি সজ্জিত হয়। সবুজ ঘাসের ডগায় ফোঁটা ফোঁটা জমা হয় শিশির বিন্দু। সে এক অপরূপ প্রকৃতি। যখন ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে সূর্যের সোনালি আলো ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুর ওপর এসে পড়ে, শিশিরগুলো সোনার টুকরোর মত জ্বলজ্বল করে। ফুলের দিকে ছুটে যায় মৌমাছিরা। সে দৃশ্য চোখ জুড়ানো, মন ভোলানো। মধু সংগ্রহের উদ্দেশে তারা ছুটে চলে অবিরত।

এ সময়ে কৃষকরা ব্যস্ত থাকে সবজি বা ফসলের ক্ষেতে। অন্যদিকে কৃষক বধূরা বিভিন্ন ধরনের পিঠা বানাতে ব্যস্ত থাকে। চারদিক খেজুরের রসে গুড় বা পায়েস রান্নার ধুম পড়ে যায়। ছোট ছেলে-মেয়ে, বৃদ্ধরা খড়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত পোহায়। হিম শীতল আবহাওয়া থেকে মুক্তির জন্য বেছে নেয় এ পদ্ধতি। কারণ শীতকালে অনেক দেরিতে সূর্যের দেখা মেলে। শহরের তুলনায় গ্রামে শীতের প্রকোপ বেশি। তাছাড়া গ্রামের শীতের সকালের মতো শহরের শীতের সকাল এতটা মনোরম হয় না।

> আরও পড়ুন- অতিথি পাখির কলতান 

Advertisement

গ্রামের বধূদের মতো বিচিত্র ধরনের পিঠা তৈরি করা আর তা আমোদ করে খাওয়ার চিত্র শহরে তেমন দেখা যায় না। তাই গ্রামের বিচিত্র শীতের পিঠার কথা বলতে গিয়ে কবি আহসান হাবীব বলেছিলেন, ‘শীতের পিঠা, শীতের পিঠা/ ঝাল নোনতা বেজায় মিঠা/ পাটি সাপটা, চিতই ভাপা/ মালাই ঠাসা কিংবা ফাঁপা/ খেজুরের রসে হাবুডুবু/ মাখছে খালা, ভাজছে বুবু।’

শীত উপভোগ্য আর রূপময় হলেও কারো কারো জন্য এটি চরম অভিশাপও। যাদের গরম কাপড়ের অভাব, বসবাস করার নির্দিষ্ট জায়গার অভাব। তাদের জন্য শীতকাল অভিশাপ। কারণ তাদের গায়ে গরম কাপড় থাকে না, মাথার উপর ছাদ থাকে না, ঘরে থাকে না নতুন ফসল। তবু তারা প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার অভিনয় করে। শীতের কুয়াশাছন্ন সকাল তাদের জীবনে সৌন্দর্য নয় বরং কান্নার প্রতিরূপ। শহরের বস্তি, ফুটপাতের মানুষের জন্য কষ্ট।

বৃদ্ধরা শীতে ঠকঠক করে কাঁপে। কষ্টের শেষ নেই শিশুদের, দাঁতে দাঁত চেপে জড়সড় হয়ে বসে থাকে কাঁপুনি ঠেকাতে। সামান্য এক টুকরো কাপড়ে শীত নিবারণ করে। সূর্যের একটু উত্তাপের জন্য সারারাত ভোর হওয়ার প্রতীক্ষায় থাকে। সুকান্ত ভট্টাচার্য তাই সূর্যের কাছে অনুরোধ করে বলেন, ‘হে সূর্য, তুমি তো জানো, আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব/ সারারাত খড়কুটা জ্বালিয়ে এক টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই।’ তাই যখন গরম আভা এই অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছায়; তখন তারা রোদ পোহানোর জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। একটু সূর্যের আলো তাদের কাছে সোনার চেয়েও দামি মনে হয়।

> আরও পড়ুন- শীতের রোদ মিষ্টি

Advertisement

কষ্টের হলেও শীতকাল কৃষকের কাছে আবার আনন্দেরও কারণ। শীতে ফলানো যায় নানা রকমের শাক-সবজি। চারদিকে যেন সবুজের বেষ্টনী। মাঠে মাঠে হলুদ শর্ষে ফুলের সমারোহ। সব মিলিয়ে শীতের প্রকৃতি যেন মানুষের মনে এক একান্ত অনুভবের সৃষ্টি করে। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে আসা পাখিগুলো যেন শীত এলেই তাদের নীড় খুঁজে ফেরে বাংলার বুকে। একসময় তারা আবার চলে যায় নিজ গন্তব্যে।

ঋতুচক্রের পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি আবার অন্য রূপে সাজে শীতের শেষভাগে। আর তাই তো প্রকৃতিকে অপরূপ রঙে সাজিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো বিদায় নেবে শীত।

লেখক: শিক্ষার্থী, কড়ৈতলী উচ্চ বিদ্যালয়, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।

এসইউ/এমকেএইচ