সারাদেশে একটা উৎসব হয়ে গেলো। এ উৎসব অবশ্য এবারই প্রথম নয়। গত আট বছর ধরেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিনেই কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেয়ার যে এক অভাবনীয় কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিলো তা এখন আরো বিস্তৃত হয়েছে। সংখ্যাগত দিক থেকে তা দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে তা জটিল হয়ে উঠার কথা ছিলো।
Advertisement
এবার নির্বাচন সংক্রান্ত কাজে সবার মনোযোগ বেশি থাকায় বই উৎসবের এ কর্মযজ্ঞে কিছুটা এদিক ওদিক হলেও হয়ত অবাক হতাম না। কিন্তু অভাবিত ব্যাপার হচ্ছে , ঘড়ির কাটা ঘুরে নতুন বছরে পড়তেই সে বই উৎসব হয়েছে সারা দেশব্যাপী আগের মতোই। বছরের প্রথম দিনে এর চেয়ে খুশির খবর আর হয় না।
২০১০ সালে যখন বিনামূল্যে এই বই দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয় তখন শিক্ষার্থী ছিল আড়াই কোটির মতো। আর এখন শিক্ষার্থী বেড়ে হয়েছে চার কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার। বইয়ের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭২ কপি।
এমন এক কর্মযজ্ঞ নির্বিঘ্নে শেষ হয়েছে এ কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ধন্যবাদ পেতেই পারে। তবে, একই সাথে অনুরোধ করব বই উৎসবের এমন মহতী কাজ দিয়ে যে আনন্দযজ্ঞ শুরু হলো তা যেন ফি বছরের মতো ‘প্রশ্নফাঁস’ নামক বিষের জ্বলুনিতে পুড়ে অঙ্গার না হয়।
Advertisement
জাতি গঠনের প্রথম যে উপাদান তা হলো শিক্ষা। একটা উন্নততর জাতি গড়ে তুলতে হলে উন্নতবোধ সম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। পশুপাখি জন্মেই তো পশুপাখি। কিন্তু মানুষ জন্মেই মানুষ হয়ে ওঠে না। তাকে সাধনা করতে হয় মানুষ হয়ে ওঠার। আর সে সাধনার প্রধানতম উপাদান হলো শিক্ষা। অবশ্যই তা সার্টিফিকেট নির্ভর শিক্ষা নয়; হতে হবে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা।
বিশ্ববোধসম্পন্ন বিশ্ব নাগরিক গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া-তাতে যুক্ত হতে হলে বৈশ্বিক শিক্ষার আদলে নিজেদেরকে তৈরি হতে হবে। সন্তানদেরকে তৈরি করতে হবে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নানা স্তরে বিন্যস্ত শিক্ষার গতিধারাকে এক রাস্তায় আনতে হবে। না হলে নানা স্তরে বিন্যস্ত শিক্ষায় বেড়ে ওঠা প্রজন্মের ভেতরে মনস্তাত্বিক বিভেদ তৈরি হবে।
সমমুখী যাত্রা এতে ব্যাহত হবে। আর এ বিভেদ চলমান থাকলে অন্ধকারের শক্তিই যে বিজয়ী হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। দেশ সম্পর্কে ভুল পাঠ দিতে পারলে তরুণ প্রজন্মকে ভিন্ন ভাবনায় ধাবিত করা সহজ হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে তাই সতর্ক থাকতে হবে।
একজন শিক্ষক হিসেবে নতুন বছরে নতুন সরকারের কাছে আমার যে চাওয়া তা একটু তুলে ধরতে চাই। আমার এ দাবিগুলো একদম নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে এমন দাবি উঠেছে। আমি হয়ত তার পুনর্ব্যক্তই করলাম শুধু।
Advertisement
(১) সর্বপ্রথমে চাই, নতুন বই হাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী কোমলমতি শিশুদের মুখে যে হাসি ফুটে উঠেছে তা যেন পঞ্চম শ্রেণি অবধি বজায় থাকে। পড়াশোনার চাপে জীবনের শুরুর এ সময় যেন নিরানন্দময় না হয়ে ওঠে। তাই আমি চাই ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষা নীতির আলোকে পঞ্চম শ্রেণিতে অনুষ্ঠিত বিদ্যমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বন্ধ হোক।
তাহলে অযথা বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদেরকে পড়াশোনার চাপে জর্জরিত করতে পারবেন না। জিপিএ ৫ নামক ঘোড়ার পিছে কোমর বেঁধে তাহলে কেউ নেমে পড়বেন না। প্রশ্নফাঁস নামক দুষ্টচক্রের মুখেও তাহলে মাছি ঢুকবে। আর কোচিং নামক ব্যাধি থেকেও আমরা অন্তত মুক্তি পাব।
(২) শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্নফাঁস নামক একটা ভয়াবহ বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। স্কুলের প্রশ্নফাঁস থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধিকাংশ চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (সম্ভবত ঘ ইউনিটের, যতদূর মনে পড়ছে!) প্রশ্নফাঁস হয়েছে । এতে পড়াশোনার চেয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পাওয়ার আশায় ছেলে-মেয়ে, তাদের বাবা-মা সবাই এখন তীর্থের কাকের মতো হাঁ করে বসে থাকেন।
প্রশ্নফাঁস না হয়ে একটা ভালো পরীক্ষা হলেও যারা সুযোগ পেলো না ভর্তির বা চাকরির ক্ষেত্রে- তারা মনে করলো প্রশ্ন হয়ত ঠিকই ফাঁস হয়েছে! আমিই হয়তো তা পা্ই নি! ফলে এই যে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পাওয়ার আশা-আমার দৃষ্টিতে এটা এক ‘গণমনস্তাত্বিক ব্যাধি’তে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাধি মাদকের চেয়ে ভয়াবহ। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে যা যা করণীয় তা করতে হবে কঠোরভাবে এবং নির্মোহচিত্তে। তাহলেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নের আসায় থাকা ‘গণমনস্তাত্বিক ব্যাধি’ ( Mass Hysteria) দূর হবে।
(৩) সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থার একটা অন্যতম লক্ষ্য ছিলো মুখস্থ করা কমানো, কোচিং সেন্টার বন্ধ এবং গাইড বইয়ের আগ্রাসী তৎপরতা বন্ধ করা। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এর একটাও কমেনি। বন্ধ তো পরের কথা। বরং বেড়েছে। এক শ্রেণির শিক্ষক নিজে সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নে ব্যর্থ হয়ে গাইড বইয়ের সাহায্য নেন। আর সেই গাইড বই ছেলে-মেয়েদেরকেও কিনতে বাধ্য করেন।
এ সুযোগ নিয়ে গাইড বই ব্যবসায়ী এবং কোচিং সেন্টারগুলো ফুলেফেঁপে আরো রমরমা হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা চললে প্রশ্নফাঁসও হয়ত বন্ধ হবে না। তাই সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো জোরদার করে মুখস্থ বিদ্যা, কোচিং সেন্টার এবং গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি দিতে কর্মপন্থা নিতে হবে।
(৪) এ বছর থেকে বিশ্ববিধ্যালয়গুলোতে অবশ্যই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা শুরু করা হোক। আর কোনো গাফিলতি, অজুহাত দেখতে চাই না সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে। রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের আদেশও কিভাবে উপেক্ষিত হতে পরে- গত চারটে বছর ধরে তা দেখে আসছি। এটা তাই আর একদমই দেখতে চাই না।
ছেলে-মেয়েরা এবারও পরিবহন ধর্মঘটের কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারেনি। গতবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকেই পারেনি যানজটের কারণে—সেটাও আমার মনে আছে। অন্ততপক্ষে মোটাদাগে যদি এ চারটে চাওয়া পূরণ হয় তাহলে আমি দারুণ খুশি হবো।
চারটের মধ্যে ১,২,৪ পূরণে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। আর সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো জোরদার করার কাজটা অব্যাহত বা বেগবান করতে পারলে ৩ নং চাওয়াটাও হয়ত একসময় পূরণ হবে। সেই আশায় চেয়ে রইলাম।
লেখক : শিক্ষক, চিকিৎসক।
এইচআর/জেআইএম