মতামত

মন্ত্রিসভায়ও সুনামির ঢেউ!

একাদশ সংসদ নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই কলামে আমি সে ফলাফলকে সুনামি হিসেবে অভিহিত করেছিলাম। ঠিক এক সপ্তাহ আগে এই কলামের শিরোনাম ছিল 'শেখ হাসিনার সুনামিতে ভেসে গেল বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট'।

Advertisement

এক সপ্তাহ পর আবারও লেখার শিরোনামে সুনামি। নির্বাচনের ফলাফলের যে সুনামি তা এসেছিল, জনগণের রায়ে। আর সেই সুনামিতে ভেসে গিয়েছিল বিএনপি, ঐক্যফ্রন্ট, ড. কামাল, রব, মান্না, জাফরুল্লাহ, তারেক, খালেদা জিয়াসহ অনেককিছুই।

অবিশ্বাস্য সে জনরায় চমকে দেয় দেশী-বিদেশী সবাইকেই। আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসছে, এটা অনুমিতই ছিল। কিন্তু এমন একচেটিয়া ফলাফল আসবে, সেটা আওয়ামী লীগাররাও ভাবেনি। চমকের সেই ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই এবার সুনামির আফটার শক। তবে এবারের সুনামি জনরায়ের অকল্পনীয় ঢেউয়ের মত হঠাৎ আসেনি।

মন্ত্রিসভার সুনামির ঢেউ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব পরিকল্পিতভাবে তুলেছেন। সেই সুনামিতে ভেসে গেছেন, এমন সব নাম, যা আসলে আমাদের দুর্বল কল্পনাশক্তিতে কুলায় না। মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের চেয়ে বাদপড়াদের নিয়ে বেশি আলোচনা কোথায় কবে হয়েছে?

Advertisement

অন্তত গত তিনদশক ধরে দল বা সরকার; আওয়ামী লীগ বলতেই যাদের বুঝতো মানুষ, তাদের বেশিরভাগই নেই নতুন মন্ত্রিসভায়। আমির হোসেন আমু আর তোফায়েল আহমেদের নাম আওয়ামী লীগের সাথে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হতো। একসময় তৃণমূলেও আমু-তোফায়েলের অনুসারী ছিল। বহুল আলোচিত ১/১১ বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশ ওলটপালট করে দিয়েছিল।

আরো অনেকের মত ছিটকে পড়েছিলেন আমু-তোফায়েলরাও। দলের নীতিনির্ধারণী সভাপতিমণ্ডলীর বদলে তাদের ঠাঁই হয়েছিল উপদেষ্টামণ্ডলীতে। তবে নিজেদের ধৈর্য্য, ত্যাগ, নিষ্ঠা আর দলের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ান তারা।

আমু, তোফায়েল, সুরঞ্জিত, কাদের, মেনন, ইনুর মত দল ও জোটের অভিজ্ঞদের কাছে ডাকেন শেখ হাসিনা। এদের মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পরলোকগমন করেছেন। বাকিদের মধ্যে কেবল ওবায়দুল কাদেরই টিকে আছেন। ওবায়দুল কাদের অবশ্য বিরল এক রেকর্ড গড়েছেন। শেখ হাসিনার চার দফা সরকারেই ছিলেন ওবায়দুল কাদের। আর কারো এই সৌভাগ্য হয়নি। ওবায়দুল কাদেরের মত ৯৬ সালের সরকারের সাথে আরো দুটি যোগসূত্র আছে নতুন সরকারে।

নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর পিতা আবদুর রৌফ চৌধুরী ৯৬ সালে শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। নতুন সরকারের পরিবেশ উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহারের স্বামী বর্তমানে খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকারের ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।

Advertisement

আমু, তোফায়েল, কাদেররা আগের সরকারেই ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেলেও মোহাম্মদ নাসিমের আরেকটু সময় লেগেছিল। নবম সংসদে তিনি ছিলেনই না। দশম সংসদে ফিরে এসেছিলেন, ফিরেছিলের মন্ত্রিসভায়ও। কিন্তু নতুন মন্ত্রিসভায় ফিরতে পারেননি। ৯৬ সাল থেকে কৃষি মন্ত্রণালয় মানেই মতিয়া চৌধুরী। বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যও এসেছে মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বেই। গত ১০ বছর শিক্ষা মানেই নুরুল ইসলাম নাহিদ। কিন্তু এবার বাদ পড়েছেন, এই দুই কমিউনিস্টও। বাদের তালিকা নতুনের চেয়ে লম্বা। নতুন এসেছেন ৩১ জন, এদের মধ্যে ২৭ জন এবারই প্রথম মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। আর বাদ পড়েছেন ৩৬ জন! কে কেন বাদ পড়েছেন বা কেন ডাক পেয়েছেন; সেটা শেখ হাসিনা জানেন। কারণ এটা তাঁর একক এখতিয়ার। তবে কিছুটা ধারণা করা যায়।

অনেকে বাদ পড়েছেন স্রেফ বয়সের কারণে। যেমন ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক, শামসুর রহমান শরিফ, মতিউর রহমান। আগের মন্ত্রিসভার সিনিয়র মোস্ট সদস্য এ এম এ মুহিত তো অবসরেই গেছেন। আবার অনেকে বাদ পড়েছেন বিতর্ক আর পারফরম্যান্সের কারণে। ফেসবুকে একজন লিখেছেন, 'নতুন মন্ত্রিসভা দেখে যতটা না খুশি হয়েছি, তারচেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছি শাজাহান খানকে না দেখে।'

আসলেই গত ১০ বছর ধরে অসংবেদনশীল নানা কথা আর আচরণে শাজাহান খান একাই সরকারের ভাবমূর্তি তলানিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্বার্থের সংঘাতের ধারণাকে দুমড়ে-মুচড়ে নিজের মন্ত্রণালয় ফেলে অন্য মন্ত্রণালয়ের কাজে নিয়মিত নাক গলাতেন তিনি। এক শাজাহান খানকে বাদ দিয়ে শেখ হাসিনা অনেকের দোয়া পাবেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিতর্ক নুরুল ইসলাম নাহিদের গলায় ফাঁস হয়ে আটকে ছিল। তার বিদায়টা তাই অপ্রত্যাশিত নয়। ব্রাজিল থেকে পচা গম আমদানির কেলেঙ্কারির কারণে 'গমরুল' খেতাব পাওয়া এডভোকেট কামরুলের বাদ পড়ায়ও অনেকেই খুশি। আওয়ামী লীগের রাজপথের লড়াকু সৈনিক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী একাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। তখনই ধারণা করা হচ্ছিল, মামলা-মোকদ্দমা আর মেয়ে জামাইয়ের কাণ্ডে বিতর্কিত মায়া আর নতুন কেবিনেটে থাকছেন না।

শেষ সময়ে মন্ত্রিসভায় এসেও কোনো চিহ্ন রাখতে পারেননি শাহজাহান কামাল। বরং 'প্রয়োজনে নিজের রক্ত দিয়ে হলেও বিমানকে লাভজনক করবো' এমন হাস্যকর কথা বলে নিজের বিদায় নিজেই নিশ্চিত করেছেন। তবে তার সঙ্গে ঠাঁই পাওয়া মোস্তাফা জব্বার কিন্তু টিকে গেছেন। আর ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় যা যা কাণ্ড করেছেন, তাতে অনেক আগেই তাকে বাদ দেয়া উচিত ছিল। সরকারের ভাবমূর্তি বিবেচনায় হয়তো তাকে এতদিন সহ্য করা হয়েছে। তবে প্রথম সুযোগেই তাকে মনোনয়নবঞ্চিত করা হয়েছে। নতুন মন্ত্রিসভায় জয় থাকছেন না, এটা আর আলাদা করে উল্লেখ না করলেও চলে।

তবে আমু, তোফায়েল, মতিয়া, নাসিমের মত চার স্তম্ভের বাদ পড়াটা না বয়সের কারণে, না পারফরম্যান্স। কারণ এই চারজনই মন্ত্রণালয়ে সফল, তেমন কোনো বিতর্কও নেই। এটা একদমই শেখ হাসিনার নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। হয়তো তারা সংগঠনে আরো বেশি সক্রিয় হবেন। এমনকি আমু-তোফায়েলকে সভাপতিমণ্ডলিতে ফিরিয়ে আনারও সুযোগ আছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীতে ৩টি পদ এখনও ফাঁকা আছে।

শেখ হাসিনার এবারের মন্ত্রিসভা তাঁর অনেক সাহসী সিদ্ধান্তের দলিল। এতে প্রমাণিত হয় দল ও সরকারে তাঁর আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ আরো নিরঙ্কুশ হয়েছে। সংসদ সদস্যদের মধ্যে শেখ হাসিনার পরিবারের অনেক সদস্য থাকলেও এবার মন্ত্রিসভায় কেউ নেই। মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের শ্বশুর খন্দকার মোশাররফ হোসেন সর্বশেষ সরকারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী থাকলেও এবার তিনিও নেই। ৯৬ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম ১/১১এর পর আর ডাক পাননি।

সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক হলো দল আর সরকারকে আলাদা রাখার চেষ্টা। আওয়ামী লীগের ৩৮ সদস্যের উপদেষ্টামণ্ডলী আর ৮৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ এই মোট ১২১ জনের মধ্যে মাত্র ১৪ জন আছেন ৪৭ সদস্যের মন্ত্রিসভায়। ৩৮ সদস্যের উপদেষ্টামণ্ডলীর একমাত্র স্থপতি ইয়াফেস ওসমানই টিকেছেন মন্ত্রিসভায়। ২০০৮ সালের পর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ঢুকে এখন তিনি পরপর দুই সরকারের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী। শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের ছাড়া আর ড. আব্দুর রাজ্জাকই মন্ত্রিসভায় দলের সভাপতিমণ্ডলীর প্রতিনিধিত্ব করবেন।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ড. হাছান মাহমুদ, শ ম রেজাউল করিম, টিপু মুনশি, শেখ মোঃ আব্দুল্লাহ পেয়েছেন পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল মজিদ হুমায়ুন গুরুত্বপূর্ণ শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। আরেক কেন্দ্রীয় সদস্য মুন্নুজান সুফিয়ান বিরতির পর আবার ফিরে এসেছেন। তিন তরুণ সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এনামুল হক শামীম আর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মন্ত্রিসভায় তারুণ্যের বার্তা নিয়ে উপস্থিত থাকবেন।

দলের বড় নেতা মানেই বড় মন্ত্রী, এই ধারণা এবার ভেঙ্গেচুড়ে গেল। ৫৪এর যুক্তফ্রন্ট সরকারের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠন না সরকার, এমন অপশনে সংগঠন বেছে নিয়েছিলেন। পদত্যাগ করেছিলেন মন্ত্রিসভা থেকে। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা কি পরিকল্পিতভাবেই দল আর সরকার আলাদা রাখতে চাইছেন? রাখতে পারলে সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য ভালো, সরকারের জন্যও ভালো।

সরকারের পেটে ঢুকে গেলে প্রাণ হারায় সংগঠন। আর আওয়ামী লীগ বার বার নানা বিপর্যয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তৃণমূলে বিস্তৃত সাংগঠনিক শক্তিকে পুঁজি করেই। তাই সংগঠনকে প্রাণবন্ত রাখতে হবে। সরকার তাদের পারফরম্যান্স দিয়ে সংগঠনে প্রাণশক্তি জোগাবে।

এইচআর/পিআর