প্রবাস

মালয়েশিয়ায় এক বছরে ৭৮৪ বাংলাদেশির মৃত্যু

প্রবাসে বাড়ছে বাংলাদেশিদের মৃতের সংখ্যা। প্রতিদিনই প্রবাসীদের মরদেহ আসছে বাংলাদেশে। মালয়েশিয়ায় গত এক বছরে ৭৮৪ জন বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেছেন। দূতাবাস সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

Advertisement

সূত্র জানায়, গত ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সে দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন ৭৮৪ জন বাংলাদেশি। এদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক, সড়ক দুর্ঘটনা ও কনস্ট্রাকশন সাইডে মৃত্যুবরণ করেছেন।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশির সংখ্যা বেশি হওয়ায় মূলত ওই অঞ্চল থেকেই মরদেহ যাচ্ছে সর্বাধিক। এর মধ্যে তালিকায় প্রথমে আছে সৌদি আরব। এরপর যথাক্রমে মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত, ওমান ও কুয়েত।

গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর মরদেহ দেশে গিয়েছে ২০১৮ সালে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তথ্য পর্যালোচনা করে এই হিসাব পাওয়া গেছে।

Advertisement

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং ধার করে বিদেশ যাওয়ায় টাকা উপার্জনে মানসিক চাপে ভোগেন তারা। মৃত্যুর কারণ হিসেবে জানা যায়, বেশির ভাগ প্রবাসী মারা গেছেন স্ট্রোক করে। প্রবাসীদের এমন অকালমৃত্যুর কারণ নিয়ে এখনও কোনো অনুসন্ধান হয়নি। প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো মৃত্যুর এই সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গত চার বছরে যত প্রবাসীর মরদেহ এসেছে, তাদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু হয়েছে আকস্মিকভাবে।

প্রবাসী বাংলাদেশি, মৃতদের স্বজন ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হন। যে বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশে যান, সেই টাকা তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম, দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সব মিলিয়ে মানসিক চাপে ভোগেন তারা। তাই মানসিক চাপ কমাতে অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং প্রবাসী শ্রমিকদের মানসিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা তৈরি করার ওপর জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫ জন, ২০১০ সালে ২ হাজার ২৯৯ জন, ২০১১ সালে ২ হাজার ২৩৫ জন, ২০১২ সালে ২ হাজার ৩৮৩ জন, ২০১৩ সালে ২ হাজার ৫৪২ জন, ২০১৪ সালে ২ হাজার ৮৭২ জন, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮৩১ জন, ২০১৬ সালে ২ হাজার ৯৮৫ জন, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৯১৯ জন এবং ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৫৭ জনের মরদেহ দেশে ফিরেছে। অর্থাৎ গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর মরদেহ দেশে এসেছে ২০১৮ সালে।

সবচেয়ে বেশি মরদেহ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে এসেছে ১০০৮টি, কুয়েত থেকে ২০১টি, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২২৮টি, বাহরাইন থেকে ৮৭টি, ওমান থেকে ২৭৬টি, জর্ডান থেকে ২৬টি, কাতার থেকে ১১০টি, লেবানন থেকে ৪০টিসহ মোট ৩০৫৭ টি মরদেহ দেশে ফিরেছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া থেকে এক বছরে এসেছে ৭৮৪ জনের মরদেহ।

Advertisement

এ বিষয়ে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব মো. হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডল বলেন, ‘শুধু যে স্ট্রোকের কারণে প্রবাসীরা মারা যায় তা নায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখা যায়- দুর্ঘটনা, স্ট্রোক বা হৃদরোগ।

তিনি বলেন, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসীদের মরদেহ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। শুধু তাই নয় মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটি ও জনহিতৈশীদের সহযোগিতায় মরদেহ দেশে পাঠানো হয়। এ ক্ষেত্রে জনহিতৈশী ও কমিউনিটির বিরাট অবদান রয়েছে। তারা দূতাবাসকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছেন বলে জানালেন এ কর্মকর্তা।

এ ছাড়া মৃত ব্যক্তিদের পরিবার মরদেহ দাফনের জন্য বিমানবন্দরে ৩৫ হাজার এবং পরে যারা বৈধভাবে কোম্পানিতে কাজ করেছেন তারা তিন লাখ টাকা আর্থিক অনুদান পায়। আর যারা অবৈধ অবস্থায় কর্ম ক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন তাদের বেলায় কোম্পানির মালিকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ আদায়ে দূতাবাস সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকে।

মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন থেকে শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছেন শরিয়তপুরের শাহ আলম হাওলাদার। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিবাসী কর্মীরা ঋণ নিয়ে বিদেশে যায়। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পর যে বেতনের কথা তাদের বলা হয়, সেগুলা তারা পায় না। তাদের ঘাড়ে ঋণের একটা বোঝা থেকে যায়। এক্ষেত্রে যেটা হয় অনেকেই এই চাপ নিতে পারে না। এতে তাদের মধ্যে টেনশন কাজ করে, ফলে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। তাই এক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে যে তারা একটি স্ট্যান্ডার্ড কর্মপরিবেশে কাজ করছে এবং এটা সরকারকেই করতে হবে। আমি এ-ও মনে করি, অভিবাসনের যে খরচ সেটা না থাকলে তাদের মধ্যে এই টেনশন কাজ করবে না। খরচ তুলে আনার বিষয়ে যে অস্থিরতা তাদের মধ্যে কাজ করে এটা আর থাকবে না।’

এমবিআর/এমএস