জীবনজুড়েই মানুষের স্বপ্ন থাকে। স্বপ্ন থাকে সফলতার। সেই স্বপ্ন সফল করতে চেষ্টা করে যান সবাই। সঠিক পন্থায় এগিয়ে গেলে স্বপ্ন সফল হবেই। তেমনই সফল হয়েছেন অগস্টিন মরমু। মালয়েশিয়া প্রবাসী অগস্টিনের সফলতার গল্প বলছেন মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর-
Advertisement
মালতি হেমরম বাজারে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে বড় ছেলে অগস্টিন। হঠাৎ মাকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে অগস্টিন জানতে চায়-: মা, কী হয়েছে! দাঁড়ালে কেন?মালতি ভাবলেন, কারণটা ছেলেকে জানাবেন না। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টালেন তিনি। হোক অবাস্তব স্বপ্ন; আকাশ-কুসুম কল্পনা। তারপরও তার এ স্বপ্নবাসনা; মনের গোপন অভিলাষ জানা থাকুক ছেলের। মালতি রাস্তার পাশে নির্মীয়মান ইটের তৈরি বাড়ির দিকে আঙুল তুলে ছেলের উদ্দেশে বললেন-: কী সুন্দর বাড়ি হচ্ছে...মালতি বাক্য শেষ না করলেও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অগস্টিনের বুঝতে বাকি থাকে না- কী বলতে চাইছেন তিনি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সদস্য অগস্টিন মরমু দীর্ঘশ্বাস গোপন করল।
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৫ নিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল সে। এরপর সুযোগ এসেছিল ঢাকার নটর ডেম কলেজে ভর্তি হওয়ার। দারিদ্র্যের কারণে সে সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। নিরুপায় অগস্টিন অবশেষে ভর্তি হয়েছিল দিনাজপুর সেন্ট ফিলিপস্ কলেজে। সেখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ইচ্ছা ছিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণের। কিন্তু মহেশপুর আদিবাসী উচ্চ বিদ্যালয়ে দফতরির চাকরি করা বাবা যশেফ মরমু অসহায় কণ্ঠে জানিয়ে দেন-: বাবা! আমার পক্ষে তোমাকে লেখাপড়া করানো আর সম্ভব হবে না। বাবার অক্ষমতা না বোঝার কথা নয় অগস্টিনের। আবাদি যে জমিটুকু ছিল, দাদা বেঁচে থাকতেই অন্যের কাছে বন্ধক দিয়ে গেছেন। স্কুল দফতরির চাকরিতে কয় টাকা আর বেতন পাওয়া যায়! অথচ সংসারে তারা তিনভাই, বৃদ্ধা দাদি আর বাবা-মাসহ ছয়জন পোষ্য। ছয়জনের ভরণ-পোষণের পাশপাশি রয়েছে তাদের তিন ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ। এ ব্যয়ভার বইতে গিয়ে মাকে পরের জমিতে ‘মজুর’ খাটতে হচ্ছে। সংসারের সামান্য স্বচ্ছলতার জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি মায়ের সঙ্গে সে নিজেও মজুর খাটতে যায়। তারপরও অভাব-অনটন যেন বিধিলিপি হয়ে রয়ে গেছে তাদের সংসারে।
> আরও পড়ুন- এসপির কল্যাণে স্বামীর ভিটায় আমিরুন
Advertisement
এভাবেই চরম হতাশা আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে যখন দিন কাটছিল অগস্টিনের, তখন একদিন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) কমিউনিটি ফ্যাসিলিটেটর মোস্তফা কামাল একটি বার্তা নিয়ে এলেন। বার্তাটি ছিল এরকম- অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের প্রকল্প ‘স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেইপ)’র মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে দেশের অন্তত ৫ লাখ ২ হাজার মানুষকে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেইপ-এর সহায়তায় দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইএসডিও ওয়েল্ডিং এবং অন্য কয়েকটি বিষয়ে বৃত্তির সুবিধাসহ আগ্রহীদের সম্পূর্ণ বিনা খরচে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। অগস্টিন আগ্রহী হলে এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।
এ কথা শোনার পর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করল না অগস্টিন। সে ভাবল- সংসারের অভাব-অনটন থেকে মুক্তি আর মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে হলে তার সামনে কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। ৪ মাস মেয়াদী ওয়েল্ডিং কোর্সে ভর্তির পর মাত্র দু’মাসের মাথায় অগস্টিন তার বাবাকে একদিন জানায়-: বাবা, একটা সুযোগ পেয়েছি। সুযোগটা হলো- কোর্স শেষ হওয়ার পর আমি ইচ্ছে করলে বিদেশে চাকরি নিয়ে যেতে পারব। বাবা যশেফ মরমু ছেলের কাছে জানতে চাইলেন-: তুমি কী চাও?একটুও দেরি না করে অগস্টিন বলল-: আমি বিদেশে যেতে চাই বাবা। নির্ধারিত সময়ে কোর্স শেষ হওয়ার পর সরকারি বৃত্তি হিসেবে পাওয়া গেল ৯ হাজার টাকা। এর সঙ্গে গরু-বাছুর বিক্রি ও স্কুল থেকে নেওয়া ঋণের টাকা যোগ হলো। তারপর একদিন পাড়া-প্রতিবেশী ও গ্রামের সবাইকে অবাক করে দিয়ে অগস্টিন মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে বিমানে উঠে বসল।
অগস্টিন তিন বছরের চুক্তিতে যোগ দিয়েছে মালয়েশিয়ার একটি কোম্পানিতে। বেতন মাসে ৩০ হাজার টাকা। ওভারটাইমসহ তা ৩৫ থেকে ৪০ হাজারের ঘরে পৌঁছায়। সবচেয়ে বড় কথা, মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর সে তার গ্রামের একজনের ভিসার ব্যবস্থা করে সেখানে চাকরি নিশ্চিত করেছে। এর ফলে গ্রামে যশেফ মরমুর কদর ও সম্মান অনেক বেড়ে গেছে বলে জানালেন তিনি। যশেফ মরমু বললেন-: আগে গ্রামের লোকজন খুব একটা পাত্তা দিত না। এখন সবাই সমীহ করে; নানা পরামর্শ চায়। কেউ কেউ আবার ছেলে কিংবা ভাইকে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারে ধর্না দেয়। পাশে বসা মালতি হেমরম এ সময় অতীত সামনে এনে ভারী গলায় বললেন-: পরের জমিতে মজুরি করার সময় পানিতে ধানের চারা রোপণ করতে গিয়ে অগস্টিনের দু’হাতে ঘা হয়ে গিয়েছিল। সে হাত দিয়ে ভাত তুলে খেতে পারত না। চোখের জল গোপন করে আমি তার মুখে ভাত তুলে দিতাম...অতীতের গ্লানি কাটিয়ে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে মালতি হেমরমের মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হয়। আপ্লুত কণ্ঠে এবার সে জানায়-: এখন ছেলে মালয়েশিয়া থেকে প্রতি রবিবার ফোন করে। ঘণ্টা পার হয়ে যায়, তবুও ফোন ছাড়ে না। মাঝেমধ্যে আমি ধমকের সুরে বলি, এবার ঘুমাতে যাও; কাল তোমাকে কাজে যেতে হবে- মনে আছে সে কথা? ছেলে হাসতে হাসতে বলে, মনে অছে মা। তবে সবচেয়ে বেশি মনে আছে, তোমার স্বপ্নের কথা। দেখো, আমি দেশে ফিরে প্রথমে তোমার জন্য ইটের তৈরি পাকা বাড়ি বানাব।
> আরও পড়ুন- বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় বুশরার পথচলা
Advertisement
মালতি হেমরমের চোখের কোণ আবারও চিকচিক করে ওঠে। তবে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না- এ কান্না বেদনার নয়; আনন্দের।
সরকারের যুগোপযোগী প্রকল্প ‘সেইপ’-এর উপযোগিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইকো-স্যোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গনাইজেশনের (ইএসডিও) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইকো-ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ইআইটি) অধ্যক্ষ এবং ‘ইএসডিও-সেইপ’ প্রকল্পের সমন্বয়কারী শাহরিয়ার মাহমুদ বললেন-: কথায় আছে, পুঁথিগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন; নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন। অন্যের পকেটে টাকা রেখে যত পরিকল্পনাই করা হোক না কেন, প্রয়োজনের সময় তা পাওয়া না গেলে কোনো কাজে আসে না। একইভাবে বিদ্যার ঝুড়ি যতই পূর্ণ হোক, যদি তার গ্রহণযোগ্যতা না থাকে; অর্থাৎ বিদ্যালব্ধ জ্ঞান যদি কাজে লাগানো না যায়, তাহলে তা মূল্যহীন।
শাহরিয়ার মাহমুদের কথা যে মিথ্যে নয়, দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশোন্মুখ লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর অসহনীয় বেকারত্বের যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়ার জীবনচিত্রে তারই প্রতিফলন লক্ষ্য করি আমরা। শুধু কি দেশীয় শ্রমবাজার? দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারেও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে আমাদের দেশ থেকে যে জনশক্তি রফতানি হয়, তাদের অধিকাংশই আধা-দক্ষ বা অদক্ষ পর্যায়ের। অদক্ষ হওয়ার কারণে এসব শ্রমিকের মজুরির পরিমাণ হয় খুবই কম। ফলে জমিজমা বিক্রি বা ঋণ করে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার পর উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও খরচের টাকা উঠানোই তাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়ে।
বর্হিবিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যথেষ্ট দক্ষ না হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অপূর্ব সুযোগটি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে ‘সেইপ’-এর উদাহরণ টেনে ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বললেন-: ‘সেইপ’-এর কোর্সগুলো সাংঘাতিক রকমের স্কিলডবেইজড; মেইনস্ট্রিম তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য যা খুবই উপযোগী। এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত বিভিন্ন ট্রেডে প্রতিবন্ধীসহ যারাই প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, তাদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগেরই চাকরি হয়ে যাচ্ছে। বাকিরাও বসে নেই; উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন ব্যবসায়ে নিয়োজিত হচ্ছে। আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান গর্বিত এই ভেবে যে, সরকার দেশব্যাপী দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের যে কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে; আমরাও তার অংশীদার।
> আরও পড়ুন- বাদাম বিক্রির টাকায় ভাইকে পড়াচ্ছেন মোজাহার
প্রতিবেশী দেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ বেকারত্ব হ্রাসের পাশপাশি মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সন্দেহ নেই, ‘সেইপ’ও একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যাচ্ছে।
এসইউ/পিআর