বিশ্ব ফুটবলের আরো একটি বছর শেষ হয়ে গেল। হাসি-কান্না, পাওয়া না পাওয়ার এই বছর ছিল বহুল আলোচিত। তবে সব আলোচনাকে ছাপিয়ে মেসি-রোনালদোর ব্যক্তিগত ট্রফিহীন থাকাটাই যেন বেশি আলোচনায়। তাদের যুগের অবসান ঘটালেন ক্রোয়েশিয়ান মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচ।
Advertisement
বিশ্বকাপের বছরটাতে প্রায় সব পুরস্কারই দেওয়া হয়ে থাকে বৈশ্বিক এই টুর্নামেন্টটির পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে। তবে অসাধারণ কোন পারফরম্যান্স যদি কেউ দেখাতে পারেন সে ক্ষেত্রে তিনি বিবেচিত হন অনেক পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে। যদিও এমন কেউ করতে পারেনি দেখে অন্য সব ফুটবলারের থেকে এগিয়ে ছিলেন মদ্রিচ।
ক্রোয়েশিয়ার মত ছোট্ট একটি দেশকে বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলতে তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। রাশিয়া বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে আর্জেন্টিনা, নাইজেরিয়া, আইসল্যান্ডের মত দলগুলোকে টপকে গ্রুপ সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করে তার দল। আর্জেন্টিনার মত পরাশক্তির বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ে গোলও করেছিলেন একটি। এরপরের যাত্রাটা ছিল স্বপ্নের মতো।
নকআউট রাউন্ডের শেষ ষোলো, কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমিফাইনাল তিন ম্যাচের দুটিতেই পেনাল্টি শুটআউটে জয় পেয়ে ভাগ্যকে সঙ্গী করে ফাইনালে ওঠে তারা। যেখানে পরাক্রমশালী ফ্রান্সের বিপক্ষে একদমই পাত্তা পায়নি প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু তাতে কী! নিজের ফুটবলশৈলী দিয়ে ততক্ষণে তিনি জয় করেছেন কোটি কোটি ফুটবল ভক্তের মন। যার দরুন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের তকমাও জুটে তার কপালে।
Advertisement
ক্লাব ফুটবলেও মদ্রিচ ছিলেন অন্য সবার থেকে এগিয়ে। রিয়াল মাদ্রিদকে লিগ শিরোপা দিতে না পারলেও জিতেছেন টানা তৃতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপাও। তার রিয়াল মাদ্রিদ সতীর্থ রোনালদো গোল করে মদ্রিচের থেকে এগিয়ে থাকলেও সার্বিক বিবেচনায় মদ্রিচ ছিলেন অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে।
মূলতঃ রিয়ালকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এনে দেয়ার পাশাপাশি নিজ দেশ ক্রোয়েশিয়াকে বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠানোর কারণে তিনি এগিয়ে ছিলেন অন্য সবার চেয়ে।
বছরে ২০১৭-১৮ মৌসুম লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন লিওনেল মেসি। ৩৪ গোল করে জিতে নিয়েছেন রেকর্ড পঞ্চম গোল্ডেন বুট শিরোপা; কিন্তু তার এই সাফল্য ম্লান হয়ে যায় নিজের ক্লাব বার্সেলোনার লিগ শিরোপা জিততে না পারা এবং আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয়ায়। তাই মেসির চেয়েও এবার মদ্রিচের সঙ্গে আলোচনায় বেশি ছিলেন ফ্রান্সের ফুটবলার আন্তোনিও গ্রিজম্যান এবং কাইলিয়ান এমবাপে।
ফ্রান্সের এই প্রজন্মটার দিকেই তাকিয়ে ছিল পুরো ফ্রান্সবাসীর মতো কোটি ফুটবল ভক্ত। তাদেরকে নিরাশ করেননি এমবাপে এবং গ্রিজম্যানরা। ফরাসীদের এই সোনালি প্রজন্মের পারফরম্যান্সের কল্যাণেই বিশ্বকাপ নিজেদের করে নেয় তারা। সবচেয়ে কমবয়সী ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করার রেকর্ডও গড়েন এমবাপে। অন্যদিকে, গ্রিজম্যান ছিলেন বিশ্বকাপে ফ্রান্সের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা; কিন্তু তারা কেউই পারেননি মদ্রিচের শ্রেষ্ঠত্বকে ম্লান করতে।
Advertisement
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে টপকে ইউরোপিয়ান বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছেন মদ্রিচ। সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার হওয়ার ক্ষেত্রেও। এখানেও রোনালদোকে টপকান তিনি। বছরের সবচেয়ে আলোচিত পুরস্কার ছিল ব্যালন ডি’অর। যেখানে ১০ বারের বিজয়ী মেসি-রোনালদোকে টপকে তাদের যুগের অবসান ঘটান মদ্রিচ। ১২ বছর পর প্রথমবার এই তিনটি পুরস্কারের একটিকেও ছোঁয়া হলো না মেসি কিংবা রোনালদোর।
মেসি-রোনালদোর যুগের অবসান ঘটিয়ে মদ্রিচ বুঝিয়ে দিলেন একজন মিডফিল্ডার হয়েও, ভুরি ভুরি গোল না করেও বিশ্বসেরা ফুটবলার হওয়া যায়। বছরের শেষ মুকুট হিসেবে তিনি অবধারিতভাবেই জয়লাভ করেন ক্রোয়েশিয়ার বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার এবং বলকান স্পোর্টসম্যান অফ দ্য ইয়ারের পুরস্কারও। এগুলোর পাশাপাশি ক্লাবের হয়ে জিতেছেন বছরের শেষ ট্রফি ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপের শিরোপা। তাই, নির্দ্বিধায় বলা যায় ২০১৮ বছরটা ছিল কেবলমাত্র মদ্রিচেরই বছর।
২০১৮ সালের বিশ্ব ফুটবল পাড়ায় মদ্রিচ ছাড়াও ছিল কিছু আলোচিত বিষয়। বছরের শুরুতেই লিভারপুল থেকে ব্রাজিলিয়ান তারকা কৌতিনহোকে দলে ভিড়িয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল বার্সেলোনা।
রিয়াল মাদ্রিদের টানা তৃতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা ছিল ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগও চমকের পসরা সাজিয়ে বসেছিল। প্রথম ক্লাব হিসেবে প্রিমিয়ার লিগে ১০০ গোল করার কৃতিত্ব দেখিয়েছে পেপ গার্দিওলার শিষ্যরা। সঙ্গে জিতেছিল প্রিমিয়ার লিগ শিরোপাও।
বছরের মাঝামাঝি চেলসি বস কন্তের বিদায় এবং নাপোলির কোচ সারির চেলসির দায়িত্ব নেওয়া, বছরের শেষ দিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ মরিনহোর ক্লাব ছাড়াটা ছিল প্রিমিয়ার লিগে এ বছরের অন্যতম আলোচিত বিষয়।
প্রিমিয়ার লিগের মত লা লিগা কিংবা ইতালিয়ান লিগেও চমকের কমতি ছিল না। রিয়ালকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জিতিয়েই দলটির কোচের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে দিয়েগো সিমিওনের ইউরোপা লিগ জয়টাও ছিল লা লিগার ক্লাবটির অন্যতম সাফল্য।
ইতালিয়ান লিগের সবচেয়ে বড় চমকটি দেখিয়েছে জুভেন্টাস। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে রেকর্ড ফি তে পাঁচবারের বর্ষসেরা ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে দলে ভিড়িয়ে সারা বিশ্বকে চমকে দেয় তারা। সারির অবর্তমানে ন্যাপোলিতে তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে আবারো ইতালিয়ান লিগে নিজেকে প্রমাণ করতে আসেন দুইবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী কোচ কার্লো আনচেলত্তি।
বছর জুড়ে আলোচনা-সমালোচনার পাশাপাশি গোলের খেলা ফুটবলে এক অসাধারণ বছর পার করেছে ফুটবলপিয়াসুরা। তাদের সেই আনন্দের হাওয়ায় নতুন মাত্রা যোগ করে রাশিয়া বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ নিয়ে নানা আশঙ্কা থাকলেও পৃথিবীর ইতিহাসে সেরা বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ রাশিয়া।
আরআর/আইএইচএস/এমকেএইচ