মধ্যযুগের শেষ ভাগ। বাংলার আকাশে সত্যিই দুর্যোগের ঘনঘটা। নবাবি শাসনের অবসান আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের শুরুর সময়। চারিদিকে অরাজকতা। বর্গীদস্যুরা লুটে নিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম।
Advertisement
অন্যদিকে রয়েছে মগ, হার্মাদদের অত্যাচার। বাংলার পল্লীগ্রামের অবস্থা তখন শোচনীয়। নিরাপদে পথটুকুও চলার জো নেই। ঠগী দস্যুরা নিরীহ পথচারীকে হত্যা করে তার সম্পদ অপহরণ করছে হরহামেশাই। বিয়ের আসর থেকে কন্যাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে বর্গী ও ডাকাতের দল।
বাংলার ঘরে ঘরে প্রকট হয়ে উঠছে দারিদ্র্য। একদা সুজলা সুফলা সোনার বাংলা তখন শ্মশান। মন্বন্তর চলছে। এই সময়ে যদি কোন দৈবশক্তি এসে কোন নিতান্ত দরিদ্র ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে কী চাই তাহলে তার দিশেহারা অবশ্যই হওয়ার কথা।
হয়তো সে চাইতে পারে ধনদৌলত, রাজত্ব, ক্ষমতা, প্রাসাদ বা আরও অনেক কিছু। কিন্তু সে লোকটি চাইলো খুব সামান্য অথচ অসামান্য জিনিস। আর তার এই চাওয়ার মধ্যে যেন পরিস্ফূট হলো বাংলার গণমানুষের চিরদিনের মনের বাসনা।
Advertisement
বলছি কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের কথা। দেবী অন্নদা ও খেয়ানৌকার মাঝি ঈশ্বরী পাটনির সেই বিখ্যাত কথোপকথন। দেবী অন্নদা নদী পার হলেন ঈশ্বরী পাটনির খেয়ানৌকায়। তীরে পৌঁছে তিনি মাঝিকে বর দিতে চাইলেন। যা চাইবে তাই পাবে মাঝি। ধনদৌলত, বা রাজত্ব চাইলেও দেবী দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু মাঝি সেসব না চেয়ে বললো ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’। বাংলার মানুষ চিরদিনই সহজ সরল। তারা রাজরাজত্ব জয় করতে চায় না। চায়, সামান্য গার্হস্থ্য সুখ, চায় শান্তি। যে শান্তি বাংলার সাধারণ মানুষ সুপ্রাচীন কাল থেকে খুব কমই পেয়েছে।
গাঙ্গেয় অববাহিকার এই বদ্বীপের অধিবাসীরা চিরদিনই শান্তিপ্রিয়। তারা পলিমাটিতে ফসল ফলিয়ে, নদী ও সাগরে মাছ ধরে, তাঁতে নিজেদের কাপড় বুনে শান্তিতে থাকতে চেয়েছে। কিন্তু প্রাচীন ও মধ্যযুগে ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার, বর্ণভেদের নিপীড়ন, বাংলার মানুষের জীবন করে তুলেছে অসহ্য। দক্ষিণ-ভারতীয়, তুর্কি, মোগল, ইংরেজ, জলদস্যু, মগ, বর্গী, ঠগী, নীলকর, পশ্চিম পাকিস্তানি বাংলার জনগণের সম্পদ লুটে নিতে বাংলায় তাণ্ডব চালিয়েছে বারংবার।
জনজীবনের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের মানুষ এখনও সংগ্রাম করছে। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব আমাদের বড় সমস্যা। আমাদের বড় সমস্যা মৌলবাদ ও নারী-শিশু নির্যাতন। আমাদের বড় সমস্যা দুর্নীতি। এসব সমস্যা মোকাবেলা করেই বাংলাদেশকে এগোতে হবে। আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যকে সুস্থির রাখতে হবে। বাংলার কৃষক-শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতিকে চলমান রেখেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা অবদান রাখছে দেশের উন্নয়নে। তাই দেশের নীতিমালা ও পরিকল্পনায় এদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ আইন, বিচার ও প্রশাসনকে হতে হবে জন-বান্ধব। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত থাকা গণতন্ত্রের জন্য অনিবার্য। সরকারের সামর্থ্য আছে এগুলো নিশ্চিত করার। কিন্তু সদিচ্ছা আছে কি না সেটাই মূল প্রশ্ন।
Advertisement
আমলা ও রাজনীতিবিদরা নিজেদের আখের না গুছিয়ে দেশের ভবিষ্যত সুন্দর করার চিন্তা করলেই একমাত্র এটি সম্ভব হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্টো। এই উল্টো-চিন্তার ধারাকে সোজা পথে আনা বড় কঠিন কর্ম। সেই কর্মটি দেশের কর্ণধারকেই করতে হবে সন্দেহ নেই।
২০১৮ সালের বিদায়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে ২০১৯ সালে। নতুন বছরে বাংলার মানুষের প্রত্যাশা কী? প্রত্যাশা বড়ই পুরাতন। বাংলার মানুষ শান্তিতে থাকতে চায়। দুর্ঘটনা, জঙ্গী হামলা, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকতে চায়। বেঁচে থাকতে চায় রোগ শোক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চায়।
চায় সুখ। সেই সুখ খুব বড় কিছু নয়। মহাভারতে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, যে মানুষ ঋণমুক্ত, এবং দিনান্তে নিজের ঘরে বসে শান্তিতে দুটো শাকভাত খেতে পারে সেই সুখী। বাংলার মানুষ এই সুখটাই চায়। চায় তার সন্তান যেন ভালো থাকে, বেঁচে থাকে। এই প্রত্যাশা পূরণের দায়িত্ব সরকারের। নির্বাচনে জয়লাভ বা ক্ষমতায় টিকে থাকা সুশাসকের চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পারে না। সুশাসকের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা, তাদের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করে যাওয়া।
মহাজোট নির্বাচনে জয়ের আনন্দ উপভোগের চাইতে জনতার প্রত্যাশা পূরণে মনোযোগী হবে এমনটাই আশা করি। নতুন বছরে সুখী বাংলাদেশ জন্য প্রত্যাশা করি, শুভ কামনা জানাই।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, বর্তমানের চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন।
এইচআর/জেআইএম