বছর শেষ হতে বলতে গেলে আর বাকি নেই। হাতের করই গুনলে দেখা যায় আর মাত্র বছরের এক দিন বাকি। নতুন বছরে আমরা সবাই প্রথমেই নিজের জীবনের হিসাবনিকাশ কষি। সাধারণত বাঙালির হিসাব নিকাশের মধ্যে থাকে এ বছর কোন একটা টার্গেট পূরণ করতে হবে- হয় সেটা চাকুরি জীবনে অধরা কোন প্রমোশন/বিজনেসে বড় কোন ফায়দা বাগানো।
Advertisement
তারপর থাকে এবছর হয় বাড়ি বানাবো /জমি কিনবো ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিদেশে বা নিদেনপক্ষে দেশের বিভিন্ন গলাকাটা রিসোর্টে ঘুরে বেড়ানো । ইদানিং বাঙালি স্বাস্থ্য নিয়ে ভালই চিন্তাভাবনা করে। তাই বাঙালির নতুন বছরের কাজের ফর্দে থাকে ওজন দশ কেজি কমানো (অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেক্রেই বাঙালি এক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হতে পারেনা। )
উপরে যাদের কথা বলা হলো তারা সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ। অন্যদিকে মধ্যবিত্তরা নিজ পরিধির মধ্যে টেনেটুনে চাপাচাপি করে হলেও নতুন বছরে যেকোন কিছু প্রাপ্তির জন্য কায়মনোবাক্যে তার কাছে প্রার্থনা করে (হয়তো বছর ঘুরে দেখা যায় হিসাবটা বড্ড এলোমোলো ,তারপরও আশা করতে দোষ দেখেনা মধ্যবিত্ত শ্রেণি )। আর উচ্চবিত্ত আর সমাজের নিন্ম শ্রেণির নতুন বছর নিয়ে কোন কিছু করতে প্ল্যান করতে হয় না। এই দুই শ্রেণির জীবনের চাওয়া পাওয়া–আশা নিরাশার সবকিছুর নিয়ন্ত্রক তারা।
সমাজকে থোড়াই কেয়ার করে বলে বলা যায় এই দুই শ্রেণি যেকোন বছর নিজেদের মত করেই কাটাতে পারে। এই তিন শ্রেণি ছাড়াও দেশে আছেন সচেতন অসেচতন মানুষ, দলকানা বুদ্ধিজীবী,সুশীল সমাজ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে সম্পৃক্ত মানুষ যারা প্রত্যেকেই নতুন বছরকে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা করেন। স্টোও মন্দ নয়। কারণ প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে– এটাই স্বাভাবিক। এবং তখনই আসে নিজেকে ছাড়িয়ে দেশ ও দেশের বাহিরকে নিয়ে চিন্তা আশা- আকাঙ্খা। প্রথমেই আমরা দেশ নিয়ে চিন্তা করি-কেমন যাবে আমাদের দেশের নতুন বছর। আর সামনের বছরে এভাবনাটা আমাদের মাথার মধ্যে আরো গেড়ে বসবে– এটাই স্বাভাবিক। কারণ ইতিমধ্যেই এ বছর অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো আমাদের দেশের একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
Advertisement
এই কয়দিন নির্বাচন নিয়ে আমাদের দেশের মানুষদের মধ্যে দেখলাম ব্যাপক উৎসাহ। রাস্তায় অবিরাম বাজছে বিভিন্ন দলের নির্বাচনী গান। চায়ের কাপে চলেছে নির্বাচনী ঝড়। দেয়াল ও রাস্তায় সুতোয় টানানো আছে পোস্টার। উপরে তাকালেই চোখে পড়েছে সারি বাঁধা বাতাসে দোলানো পোস্টার। হয়তো নির্বাচনের পরের দিনই অর্থাৎ আজ থেকে তা ছিঁড়ে পড়ে থাকবে রাস্তায়।
সবাই তাকিয়ে ছিল ৩০ তারিখের দিকে। সবাই ভোট দিয়ে তার নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছে সেদিন। কারো কারো মধ্যে ভোট দেয়ানেয়া নিয়ে ছিল শঙ্কা। তারপরও আমরা চেয়েছি সবার ইচ্ছা যেন দেশের জন্য সঠিক হয়। ব্যক্তির চেয়ে দেশ বড়। দেশের মানুষ (সব স্তরের) আজ চোখ কান খোলা রাখে। বুগিজুগি বোঝানো তাদের বেশ কঠিনই। আমি রিক্সাওয়ালা ভাইটির সাথে কথা বলেও দেখেছি -সেও দেখতে চায় স্থিতিশীল বাংলাদেশ। তাই জনগণকে চিন্তাভাবনা করেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যে।
আমাদের দেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। আজ আমরা অনেক দেশের জন্য উদাহরণও বটে। তাই আর আমাদের পেছন ফিরে তাকানোর কোন উপায়/পথ নেই। আমরা কেবল সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আর তা সম্ভব সৎ দক্ষ যোগ্য নেতৃত্বের হাতে দেশ চালানোর স্টিয়ারিং যদি আমরা তুলে দিতে পারি তাহলেই।
আমরা মাছেভাতে বাঙালি। আমরা শান্তিতে থাকতে চাই। কোন রকম নৈরাজ্য ,অশান্তি, বিশৃ্ঙ্খলা নতুন বছরের কোন ক্ষণই দেখতে চাই না। বহু খারাপ সময় বাংলাদেশের উপর দিয়ে গেছে। তাই চাই না নোংরা রাজনীতির খেলার পুনরাবৃত্তি। চাই না কোন পরিবার দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকারে তার পরিবারের কোন সদস্যকে হারাক। হয়তোবা সেই ছিল তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
Advertisement
নতুনবছরে চাই প্রতিটি পরিবারে মানুষ যুক্ত হচ্ছে কেবল- বিয়োগ নয় । নতুন বছরের শুরুতেই আমাদের শিশুদের প্রত্যেকের হাতে উঠবে নতুন বই। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কি আছে? নতুন বছরে কিশোরকিশোরীরা কেবল পাচ্ছে জিপিএ ৫-তা কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল চাওয়া নয়। আমাদের মূল চাওয়া হবে প্রকৃত শিক্ষা যা আমাদের মানবিক হতে শেখাবে।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তার চাই আরো সুষ্ঠু বিকাশ। দেশে আজ পাবলিক ও প্রাইভেট মিলিয়ে ১৪৯ টি বিশ্ববিদ্যালয় । নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন যোগ্য শিক্ষক দ্বারা জ্ঞানের আলো ছড়ায় এই হবে আমাদের প্রত্যাশা। বিশ্ববিদ্যালয় যেন শুধু শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট প্রদানের জায়গা না হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন হয় শিক্ষার্থীদের কর্মউপযোগী ও আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক হবার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর দায়িত্ব যাদের হাতে সেই জ্ঞানতাপসরা অবশ্যই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সেইভাবে ঢেলে সাজাবেন।
আজ উন্নয়নশীল দেশ হবার সব যোগ্যতা অর্জন করেছে আমাদের দেশ। আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় অনেক বেড়েছে। আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য নেয়া হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। আমরা আজ বাইরের সাহায্য ছাড়াই অনেক কিছু নিজেদের সামর্থ্যে করার সাহস সক্ষমতা রাখি। আগের চেয়ে দুর্নীতিও আমরা কমিয়ে এনেছি যা আশার কথাই বটে।
আমরা এমডিজি পূরণ করেছি এখন এসডিজি বাস্তবায়নের পথে। তাই চাই আমাদের অর্থনীতির এ সচলতা বজায় থাকুক। দেশের উন্নয়নের সাথে দরকার মনের খোরাকও মেটোনোও । আর তা সম্ভব একমাত্র শিল্পের বিকাশের মাধ্যমেই। হতে পারে তার মাধ্যম বই /চলচিত্র বা অন্যকিছু। পুরোনো লেখকদের বইই আজও কি আমরা কেবল পাঠ করে চলেছি ? নতুনদের খোঁজ রাখছি কি? নাকি আজকাল নবীন লেখক –গায়ক-নায়কের কিচ্ছুটি হচ্ছে না বলে নাক সিটকিয়ে যাচ্ছি ?
সোশ্যাল মিডিয়ার এ যুগে বই ভিন্ন অন্যকিছু নিয়েই কি আমরা ব্যস্ত? নতু ন লেখকদের প্রতিষ্ঠিত করার প্ল্যাটফর্ম করা সম্ভব নয় কি নতুন বছরে? শুধু কিছু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমেই কি নতুন লেখক কে সমাজে পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায় ? আজকাল তো আবার পুরস্কারও নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। দিনদিন সবকিছুই কি দলাদলি স্বজনপ্রীতির কবলে চলে যাচ্ছে? নতুন বছর আসছে। আসবে নতুন ভোর। আমরা যারা নতুন বছরকে বরণ করে নিতে পারবো অর্থাৎ আরেকটি বছরে পৃথিবীর রুপ-রস প্রাণভরে উপভোগ করতে পারবো তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। নতুন বছরের প্রতিটি দিনক্ষণ বাঙালির জন্য হতে হবে আনন্দের। যাপনের। কোন দুঃসহ সময় আমাদের আকাঙ্খিত নয়। সবুজ এই বাংলার মানুষদের এত ছোটছোট স্বপ্নগুলো কি তবে নতুন বছরে পরিপূর্ণ হবে না?
অবিশ্বাস্য মনে হলেও তা হবেই। আর তার জন্য ১৬ কোটি হাতকে যে এক হতে হবে। মনে রাখতে হবে এখন আমাদের দেশে রয়েছে অসংখ্য মেধাবী সম্ভাবনাময় তরুণ হাত। চলুন নতুন বছরে নিজেকে বদলাই। নিজের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগাই। শুধু ব্যক্তিস্বার্থে নিমগ্ন না হই। মাথায় রাখি নিজের দেশের কথা। নিজেকে যেন কোন কিছু থেকে পালিয়ে বেড়াতে না হয়- হোক তা ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবনে।
নিজের খারাপ দিকগুলো ডাস্টবিনে ফেলা ময়লার মত ছুঁড়ে ফেলে নতুন বছরে নিজেকে ও প্রিয় বাংলাদেশকে গড়ার ইতিবাচক স্বপ্ন দেখি। আর এই স্বপ্নই হয়তো হবে একদিন বাস্তব।
এইচআর/এমকেএইচ