একটি নতুন বছর শুরুর আগমুহূর্তে এবং একটি বছর শেষের শেষমুহূর্তে বাংলাদেশ যে নতুন সময়ে পা রাখলো তার জন্য অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্যই এই লেখা।
Advertisement
একটু পেছনে ফিরে যাই। ২০১৩ সালের শেষ দিকে শেখ হাসিনা ফোন করেছিলেন বেগম জিয়াকে, তখন তিনি ক্ষমতায় এবং একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের মিলিত প্রচেষ্টার লক্ষ্যে তিনি ফোন করার পর বেগম জিয়া তাকে রীতিমতো অপমান করেছিলেন। সেই অপমানই শেষ নয়, নির্বাচনের আগে ও পরে প্রায় এক বছর ধরে বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে এক ভয়ঙ্কর জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। রাজনীতিকে মানুষ ভয় পেতে শুরু করেছিল সেই আগুন-সন্ত্রাসের কারণে।
তারপর দীর্ঘ পাঁচ বছরে বুড়িগঙ্গা আরো বুড়ি হয়েছে। বেগম জিয়া ও তার দল বহু হেরাফেরি করেও দুর্নীতির দায়ে প্রাপ্ত শাস্তি এড়াতে পারেননি, তিনি কারাদণ্ড ভোগ করছেন। দলকে ছেড়ে দিয়েছিলেন তার চেয়েও এককাঠি সরেস পুত্রের হাতে যে কিনা বাংলাদেশকে মনে করেছেন লুটেপুটে খাওয়ার ভাণ্ডার।
পলাতক ও সাজাপ্রাপ্ত হয়েও বিএনপি’র মতো একটি প্রবল গণভিত্তির দলকে নেতৃত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন দেশের ‘প্রবাসী সরকার’ পরিচালনা করার চেষ্টা করে গেছেন তারেক জিয়া। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। কিন্তু সে ফল নিয়ে বিস্তারিত বলার আগে ড. কামাল হোসেন সম্পর্কে কিছু কথা বলার আছে।
Advertisement
ড. কামাল হোসেনকে দেশে-বিদেশে সকলেই একজন ঝানু ব্যারিস্টার বলেই সম্মান দেন। বাংলাদেশের স্বার্থ-বিরোধী বিদেশি কোম্পানির হয়ে বহুবার তিনি লড়েছেন এবং বাংলাদেশকে হারিয়ে বিদেশি কোম্পানিকে জিতিয়ে দিয়েছেন। তা তিনি একজন উকিল হিসেবে তার মক্কেলকে জিতিয়ে দিতেই পারেন কারণ এটাই তার ‘রুটি-রুজি’। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি যে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান (অন্ততঃ বক্তৃতা-বিবৃতিতে তিনি এতোদিন যা বলে এসেছেন) সেই বাংলাদেশের সঙ্গে যে কোনো বিবেকবান, দেশপ্রেমিক মানুষ একাত্মতাবোধ করতে বাধ্য। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের কথা বলেন এবং তাঁকে জাতির পিতাও মানেন। এর চেয়ে বড় কোনো পরিচয় ড. কামাল হোসেনের জন্য হতে পারে না যে, তিনি আসলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম।
ড. কামাল হোসেনের রাজনীতি প্রশ্নের মুখে পড়ে যখন ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলের শেষে এসে একটি রাজনৈতিক সংকটে পড়া দেশে ‘মাইনাস টু থিওরি’কে সামনে রেখে রাজনীতি শুরু হয়। বলা হয়ে থাকে যে, ড. কামাল হোসেনসহ দেশের সুশীল সমাজের বাঘা বাঘা প্রতিনিধিরা দেশে একটি ‘বিরাজনীতিকরণ’ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এটা কোনো গোপন ঘটনা ছিল না, সকলেই পত্রিকায় লিখে কিংবা বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে এই প্রক্রিয়ার অংশীদার হওয়াটাকে গৌরবজনক মনে করেছেন এবং পরবর্তীতে এর জন্য তারা কোনো অনুশোচনা বা দুঃখপ্রকাশ করেছেন বলে জানা যায় না। মানুষ এক্ষেত্রেও ড. কামাল হোসেনকে মেনে নিয়েছিলেন কারণ দুই নেত্রীর বাইরে একটি তৃতীয় শক্তি বাংলাদেশে দাঁড়াক এরকমটা হয়তো অনেকেই চান। কিন্তু ২০১৮ সালে এসে কী ঘটলো?
বিএনপি-জামায়াত যখন রাজনৈতিক ভাবে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে, দুর্নীতির দায়ে যখন দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব কারাদণ্ড ভোগ করছে, যখন যুদ্ধাপরাধের দায়ে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায় ও নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী দুর্বল হয়ে পড়েছে তখন আচানক আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক ঐক্যের ডাক দিলেন ড. কামাল হোসেন।
Advertisement
যে ব্যক্তি এতোদিন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিকে নিজের আদর্শ হিসেবে বর্ণনা করে আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করেছেন তাঁর আদর্শচ্যুত হওয়ার কারণে সেই ব্যক্তিই দেশের স্বাধীনতা-বিরোধী জামায়াত ও দুর্নীতিবাজ বিএনপি’কে সঙ্গে নিয়ে নামলেন ভোটের মাঠে। উদ্দেশ্য আওয়ামী লীগকে হঠানো।
আওয়ামী লীগ ধোয়া তুলসিপাতা সে দাবি খোদ শেখ হাসিনাও করবেন না। কিন্তু যে সকল ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রশংসা করতেই হবে সেগুলো ড. কামাল হোসেনও স্বীকার করেন, অন্ততঃ মনে মনেতো বটেই। আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে গিয়ে যখন তিনি কতিপয় দলত্যাগী ও রাজনীতিতে পতিত ব্যক্তিদের নিয়ে গিয়ে তিনি দাঁড়ান বিএনপি-জামায়াতের পাশে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী শেষ মুহূর্তে তার পাশ থেকে সরে আসেন কারণ জামায়াতের সঙ্গে তিনি আর থাকতে চাননি বলে। ভোটের মাত্র একদিন আগে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকার থেকে আমরা জানতে পারি যে, ড. কামাল হোসেন আসলে জামায়াতকে এতোগুলো আসন দেওয়া হবে সেটা আগে জানতে পারলে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যেতেন না। কিন্তু তার এই বক্তব্য হাস্যকর হয়ে ওঠে তখনই কারণ স্বাধীনতা দিবসে তাঁকে একজন সাংবাদিক জামায়াত-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করায় সাংবাদিককে তিনি ‘খামোশ’ বলে থামিয়ে দিয়ে ‘দেখে নেবো’ বলে হুমকি দেন।
তিনি নির্বাচন-জোশে সকল সভ্যতা-ভব্যতার সীমা ত্যাগ করে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে পুলিশ বাহিনীকে ‘জানোয়ার’ বলে গাল দেন। এর আগে অবশ্য প্রধান বিচারপতির সামনেই দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে ‘বাস্টার্ড’ বলে ওঠেন। ড. কামাল হোসেনের বয়স হয়েছে, তিনি শারীরিক ভাবে পক্ক হয়েছেন, কিন্তু মানসিকতায় তিনি এখনও ‘শিশুটি’ থেকে গেলেন কিনা সে প্রশ্ন এখন সত্যিই বাস্তবতা লাভ করেছে।
কিন্তু ড. কামাল হোসেনকে তারপরও ধন্যবাদ দিতে হচ্ছে যে, তিনি বাংলাদেশ যখন বিরোধী-রাজনীতির ভয়ঙ্কর সময় যাচ্ছিলো তখন তাঁর হাত ধরে বিরোধী-রাজনীতি আবার ঘুরে দাঁড়ায়। যে জিয়া পরিবার বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারকে নিঃশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য ১৫ই আগস্ট ও ২১শে আগস্টের হামলার সঙ্গে যুক্ত থাকায় শেখ হাসিনার পক্ষে বেগম জিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসাটাকে অনেকেই অসম্ভব বলে ভাবতো (যদিও শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে ফোন করেন, তাঁর ছেলের মৃত্যুতে শোক জানাতে নিজে গিয়ে উপস্থিত হন), ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে তাদের সঙ্গেই শেখ হাসিনা আলোচনায় বসে নতুন নজির তৈরি করেন রাজনীতিতে।
ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারতো যদি না নির্বাচনকে দলটি জন্মলগ্ন থেকেই ছেলেখেলা ভাবতো। এই দলটি মনে করে যে, নির্বাচন মানেই হ্যাঁ-না ভোট, যেমনটি জেনারেল জিয়াউর রহমান করে ক্ষমতায় টিকেছিলেন তেমনই এক কোটি ভুয়া ভোটার কিংবা বিদেশি অর্থে সকলকে কিনে ফেলে কিংবা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচনকে নিজেদের পক্ষে টেনে নির্বাচনে বিজয় অর্জন করা ছাড়া নির্বাচন যে ভয়াবহ এক খাটুনির ব্যাপার, একটি ভোটার শ্রেণিকে সম্পূর্ণভাবে নিজের পক্ষে টেনে আনার জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রমের ব্যাপার সেটি তারা মনেই করেন না।
বিএনপি মনে করে যে, আওয়ামী লীগের বিপক্ষের সকল ভোট কোনো রকম খাটুনি ছাড়াই তাদের বাক্সে গিয়ে পড়বে। কিংবা শুধুমাত্র কিছু ভিডিও-বার্তা ছেড়ে দিলেই সারা দেশের মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে তাদেরকে বিজয়ী করবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশের মানুষ যে এরই মধ্যে বিএনপি’র সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের সংশ্লিষ্টতাকে প্রত্যাখ্যান করেছে সেই বার্তাও তারা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে।
দশ বছর ক্ষমতার বাইরে দশ দিনের জন্যও তারা যুক্তিপূর্ণ কোনো আন্দোলনের জন্য ব্যয় করেনি, জনগণের জীবনমান উন্নয়নে কোনো প্রতিশ্রুতিতো দূরের কথা কোনো কর্মসূচিও তারা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। দলীয় নেতারা ঢাকা ছেড়ে নির্বাচকমণ্ডলীর সঙ্গে দেখা করেনি কতদিন তার ঠিকঠিকানা নেই। নতুন ভোটাররা হয়তো তাদেরকে চেনেই না।
এমন একটি রাজনৈতিক দলের হাত ধরে যতোই ড. কামাল হোসেন টেনে তোলার চেষ্টা করুন না কেন, যতোই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই বলে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় বসানোটাকেই গণতন্ত্রের বিজয় মনে করুক না কেন নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর থেকেই বিএনপি-জামায়াত এই পথে হেঁটেছে যে, তারা হয় বসে বসে ভোটে বিজয়লাভ করবে নয় তারা আওয়ামী লীগের বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করবে নিজেদের অপ্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ আচরণ দিয়ে।
নির্বাচনে একেবারেই কারচুপি হয়নি সেকথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। বিএনপি-নেতা রিজভী সাহেবের কথাই ঠিক, নির্বাচন ৮০ভাগ সুষ্ঠু হয়েছে, ২০ ভাগ কারচুপি হয়েছে কিন্তু এই ২০ ভাগ কারচুপির ফলে আওয়ামী লীগের পক্ষে এরকম ‘ভোট-সুনামি’ হওয়ার কথা নয়, তার মানে হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতকে মানুষ আসলে আর ভোট দিতে চায়নি বা দেয়নি। এই সত্য মেনে নিয়ে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করুন বা মেনে নেন, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত কারণগুলো উদ্ঘাটনের চেষ্টা করলেই হবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি-রাজনীতির নবোদয়। নাহলে এতোদিন ধরে শুনে আসা ‘বিএনপি’র পরিণতি হবে মুসলিম লীগের মতো’, এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হবে।
কিন্তু সবকিছুর পরেও বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ দেশের সর্বস্তরের জনগণের উচিত ড. কামাল হোসেনকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ধন্যবাদ জানানো। একটি ভয়ঙ্কর সংঘাত থেকে দেশকে মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যেমন বিএনপি-রাজনীতিকে বাঁচিয়েছেন তেমনই আওয়ামী লীগকে বোঝার সুযোগ করে দিয়েছেন যে, দেশের মানুষ তাদেরকে কতোটা ভালোবাসে আর কতোটা দায় ও দায়িত্ব তাদের কাঁধে জনগণ দেওয়ার ঝুঁকি নিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগকেও এর প্রতিদান দিতে হবে একটি সফল, দুর্নীতিমুক্ত, দেশপ্রেমিক সরকার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে। প্রশ্ন হলো, ড. কামাল হোসেনকে তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকু বিএনপি-জামায়াত দেবেতো? ৩০ ডিসেম্বর, রবিবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/পিআর