বিশেষ প্রতিবেদন

আওয়ামী লীগ আর বাকশালের দিকে যাবে না

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ। লিখছেন সমাজ, রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। নির্বাচন এবং রাজনীতির বিষয় নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুতি ঘটার কারণেই আজকের রাজনীতির সঙ্কট বলে মনে করেন। সংস্কৃতির বিকাশ না হওয়ায় ডানপন্থী রাজনীতি সমাজে প্রভাব ফেলছে বলে মত দেন। আসন্ন নির্বাচন ব্যর্থ হলে সঙ্কট আরও বাড়বে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই বিশ্লেষক। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ শেষ পর্ব প্রকাশিত হলো।

Advertisement

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ : আগের পর্বে মুক্তিযুদ্ধের অহংকারের কথা বলছিলেন, যা তরুণদের অনেকেই ধারণ করছে না। এর কারণ কী?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষা ব্যবস্থায় ডানপন্থার প্রভাব বাড়ানো হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। ২০ বছরের সামরিক-আধাসামরিক শাসনে এটি করা হয়েছে। আপনি সেদিকে তাকাচ্ছেন না কেন? আওয়ামী লীগের ইতিহাস তো মাত্র কয়েকদিনের। আওয়ামী লীগ ইতিহাস পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছে। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগকে সাধুবাদ জানাই।

Advertisement

জাগো নিউজ : হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনের সঙ্গে সমঝোতা করে মুক্তি পুনরুদ্ধার করা যায়!

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : কিছুটা করেছে আওয়ামী লীগ। আমি তো আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগ এখন শতভাগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল না। কিন্তু অন্য দলগুলো তো সেটুকুও করছে না।

জাগো নিউজ : কিন্তু জামায়াতকে ঠেকিয়ে হেফাজতকে বুকে নেয়ার মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে কিনা?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমি আওয়ামী লীগের লোক না। আমাকে কেন এই প্রশ্ন করছেন। আপনি এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কাছে জানতে চান। আওয়ামী লীগের অবস্থান আমি আগেই পরিষ্কার করেছি। আমি আওয়ামী লীগের পক্ষের না, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। যেভাবেই মাঠ দখলে রাখুক, অন্তত আওয়ামী লীগের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারি। বিএনপির ওপর সেটা পারি না।

Advertisement

জাগো নিউজ : আপনি বিশ্বাস করছেন। কিন্তু গণমানুষের বিশ্বাসও তো গুরুত্বপূর্ণ।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গণমানুষের বিষয়ে আওয়ামী লীগের কাছে প্রশ্ন করুন। আমি বলতে চাইছি, আওয়ামী লীগ যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সঠিকভাবে থাকত তাহলে আজকের সঙ্কট তৈরি হত না। গণমানুষ তাদের সঙ্গে থাকত। একই যুক্তি অন্য দলগুলোর জন্যও। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সাড়ে তিন বছরে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশ যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো।

২১ বছর আওয়ামী লীগ নির্বাসনে থাকল। চিন্তার জায়গাটা দখল করা হলো। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যদি রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে যায়, তখন অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে আবারও ডানপন্থার চর্চা শুরু করলো। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ফের ক্ষমতায় এসে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে থাকল। ২০১৪ সালে নির্বাচনে আসলে বিএনপি বিজয়ীও হতে পারত। তা না করে ধ্বংসযজ্ঞ চালালো।

এ কারণে একতরফাভাবে আওয়ামী লীগকে দোষ দেয়া ঠিক হবে না। হারানো ইতিহাস আওয়ামী লীগ ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। তরুণরা কেন নিতে পারছে না তার কারণ বের করতে হবে।

দায় আমাদেরও। কেন রাজনীতির হাতে সব ছেড়ে দিই? এই প্রশ্ন গণমানুষের কাছে করুন। সন্তানকে তারা কী শিক্ষা দিচ্ছে? তাদের মধ্যকার চেতনা কী? দুর্নীতি, দুঃশাসন সমাজের রন্ধে রন্ধে। শুধু সরকারকে দোষ দিয়ে মুক্তি পাওয়া যাবে না। ১৫ বছর কোনো গণতন্ত্র ছিল না। শুরুতেই হোঁচট খেল। আজকের রাজনীতি সুবিধাবাদী জনগোষ্ঠী তৈরি করছে। এ কারণে ঝুঁকি নিয়ে হরতাল-প্রতিবাদে মানুষের অংশগ্রহণ নেই। এই জটিল প্রশ্নগুলোর সমাধান দরকার।

জাগো নিউজ : সমাধানের জন্য আর কত অপেক্ষা?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমি আশাবাদী মানুষ। আমি তরুণে বিশ্বাস করি। ৭১-কে ধারণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করলেই আমি আওয়ামী লীগের হয়ে যাব না। সাধারণ মানুষকে বিশ্বাসে আনতে হবে। আমার বন্ধু কাজী আকরাম যখন ক্ষেত মজুর সমিতি করেছিলেন, তখন আমি ভাবছিলাম গণমানুষের মুক্তি হতে যাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্র তা চায়নি। কিন্তু তাই বলে ভরসা হারাইনি। গ্রামের সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে পারলেই চেতনার বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কৃষক, গণমানুষকে অস্বীকার করে মুক্তি আসবে না।

সব দলেই এখন ব্যবসায়ীর প্রাধান্য। ব্যবসায়ীদের কাজই হচ্ছে কেনা-বেচা এবং দিন শেষে লাভের হিসাব কষা। ব্যবসা চ্যারিটির বিষয় না। কিন্তু রাজনীতি হচ্ছে মানুষের কল্যাণে। আমি ২০২১ সালের দিকে তাকিয়ে। তরুণরা অনেক কিছুই জানতে চাইবে। প্রশ্ন ওঠুক। প্রশ্ন থেকে সমাধান আসুক। যোগাযোগ বাড়ুক। আমি বিশ্বাস করি ২০২৪ সালের নির্বাচন সবচেয়ে ভালো একটি নির্বাচন হবে।

জাগো নিউজ : কীসের ভিত্তিতে এমন ভরসা?

আরও পড়ুন>> জামায়াতকে দূরে রাখলে ঐক্যফ্রন্টের গণজোয়ার সৃষ্টি হতো

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : বিএনপি এবারে বুঝতে পারছে, তাদের ভুলগুলো। একটি দল ক্রমাগত বিরোধী দলে থাকতে পারে না। তারা মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে সহনীয় হবে। একইভাবে আওয়ামী লীগও তাদের ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ পাবে। আমি মনে করছি, এই নির্বাচনে বিএনপি ১১০ থেকে ১২০টি আসন পাবে। যদিও ত্রিশ ভাগও কারচুপি হয়, তবুও এত সংখ্যক আসন পাবে বলে মনে করি। আর আওয়ামী লীগ হারলে তারাও বুঝতে পারবে ’৭১ নিয়ে তাদের অবস্থান কী ছিল। আগামী পাঁচ বছর উভয় পক্ষের ভুলগুলো সামনে আসবে। মানুষ শান্তি চায়। ধ্বংস চায় না। হরতালের দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি পোড়ানো মানুষ আর দেখতে চায় না।

উভয় দলই স্বচ্ছ তরুণদের নেতৃত্বে আনবে। পুরাতনদের বাতিল করে দেবে। আগামী ১ জানুয়ারি থেকেই মানুষ নতুন চিন্তায় প্রবেশ করবে।

জাগো নিউজ : কিন্তু এই নির্বাচন যদি ব্যর্থ হয়?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : নির্বাচন ব্যর্থ হবে আমি সে কল্পনাই করতে পারি না। কোনো কারণে এই নির্বাচন ব্যর্থ হলে আবারও ১/১১ এর মতো ঘটনা ঘটবে। আর এটি ঘটলে মৌলিক অধিকারই তো থাকে না।

জাগো নিউজ : প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ সরকারের হয়ে যেভাবে কাজ করছে, তাতে করে বাকশালের মতো প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে কিনা?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমি তা মনে করি না। বাকশাল একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তৈরি হয়েছিল। ডিজিটাল সময়ে এসে বাকশাল প্রতিষ্ঠা দেয়া সম্ভব না। আওয়ামী লীগ আর বাকশালের দিকে যাবে না। সমালোচনা থাকতেই পারে। কিন্তু আমার নিজস্ব অনুধাবন আছে। আমি সমালোচনায় কান দিই না। পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি।

জাগো নিউজ : যেমন?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এ সরকার ফের ক্ষমতায় আসলে বিরোধী দলহীন সংসদ পাবে না। সক্রিয় বিরোধী দল পাবে যাদের পায়ের নিচে মাটি শক্ত থাকবে। আর বাকশাল করে আওয়ামী লীগ যে ভুল করেছিল, সেই ভুল বার বার করবে না।

জাগো নিউজ : আগেও বিরোধী দল সংসদে ছিল?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : সময় বদলে যাচ্ছে। বিএনপি যখন বিরোধী দলে ছিল তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল ক্ষমতায় আসার জন্য। এবারে তা হবে না। ২০০১ সালের পর দুটি সরকার ক্ষমতায় ছিল। খালেদা জিয়ার সরকার এবং তারেক রহমানের হাওয়া ভবনের সরকার। ২০০৮ সালের পরও বিএনপি এই বিভাজনে বিভক্তি ছিল। ফলে তারা বিরোধী দলে থেকেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, যার পরিণতি দেখেছি আমরা ২০১৪ সালের নির্বাচনে। কিন্তু ২০১৮ সালের পর সংসদে বিরোধী দল কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস করছি।

জাগো নিউজ : পরিস্থিতি অনুকূলে না আসলে বিএনপি জোট নির্বাচন বয়কটও করতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : সেটা বিএনপির ব্যাপার। এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো না।

জাগো নিউজ : কিন্তু নির্বাচন তো প্রশ্নবিদ্ধ হবে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : কী হবে সেটা পরের কথা। দেশ বড় এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে তা বলতে পারি। তবে আমি মনে করি না বিএনপি এবারে নির্বাচন বর্জন করবে। বিএনপির ওপরেও চাপ আছে। সেনাবাহিনী নামায় পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে যেতে পারে। আবার নাও পারে। ভোট বর্জন করলে বিএনপিকে কৈফিয়ত দিতে হবে। কারণ বিএনপি চেয়েছে সেনাবাহিনী নামানো হোক।

জাগো নিউজ : সেনাবাহিনী আসলে কী ভূমিকা রাখতে পারে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : সরকারি দল বিএনপির প্রচারণায় যেসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, তা অনেকটাই দূর হতে পারে। নিশ্চিন্ত মনে বিএনপি প্রচার করতে পারবে।

জাগো নিউজ : প্রচারণার তিনদিনে আর কী পরিবর্তন হতে পারে? সরকার কয়েক বছর ধরে একতরফাভাবে মাঠ দখলে রেখেছে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে একদিনেই অনেককিছু করা সম্ভব। বিএনপির মধ্যেও এখন নির্বাচনমুখী চিন্তা কাজ করছে। তারা যদি শতাধিক আসন পায়, তাহলে মধ্যবর্তী একটি নির্বাচনের চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। চাপ থাকলে সরকারও সহনশীল হয়। আর ২০২৪ সালে বিএনপির জন্য অনেক সাজানো মাঠ হবে বলে ধারণা করতে পারি। আর তখন বাংলাদেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন ঘটবে।

জাগো নিউজ : বিএনপি শতাধিক আসন পেতে পারে, এই ধারণার ভিত্তি কী?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমার নিজস্ব চিন্তার ফল। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণা, মিডিয়ার খবর থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমার কাছে এই সংখ্যাটা ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে। গত এক বছর ধরে খবর রেখে এ ধারণা হয়েছে। মাঠ সমান হলে বিএনপি ক্ষমতাতেও আসতে পারতো। কিন্তু মাঠ তো অনুকূলে নেই। জনমত বিএনপির পক্ষে। যেমন জনমত ছিল ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের পক্ষে। আমি তৃণমূলের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে থাকি। জামায়াত ছেড়ে দিলে বিএনপি অনেক আগেই মাঠ গুছিয়ে নিতে পারত। তরুণরা বিএনপির পক্ষে থাকতো।

এএসএস/এমআরএম/এমএস