রাজধানীর মতিঝিল, রমনা, শাহবাগ ও পল্টন এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছেন দুই হেভিওয়েট প্রার্থী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রাশেদ খান মেনন এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস।
Advertisement
এদের মধ্যে রাশেদ খান মেনন এ আসন থেকে হ্যাটট্রিক (টানা তিনবার) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আশায় নৌকা প্রতীক নিয়ে মাঠে নেমেছেন। আর মির্জা আব্বাস প্রথমবারের মতো এ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মাঠে নেমেছেন।
প্রচার-প্রচারণায় মহাজোট প্রার্থী রাশেদ খান মেনন বিএনপি প্রার্থী আব্বাসের চেয়ে বহুগুণে এগিয়ে রয়েছেন। গত ১০ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই প্রায় প্রতিদিনই ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গণসংযোগ করছেন মেনন। অপরদিকে আব্বাস এ পর্যন্ত মাত্র তিনদিন প্রকাশ্যে গণসংযোগ করেছেন।
প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে এ দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান থাকলেও দুজনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলে মনে করছেন এ আসনের ভোটাররা। তবে এ আসন থেকে কে নির্বাচিত হবেন তা অনেকটাই নির্ভর করছে ভাড়াটিয়াদের (ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা) ওপর। কারণ এ আসনের ভোটারদের মধ্যে স্থানীয়দের চেয়ে ভাড়াটিয়ারাই বেশি।
Advertisement
গত কয়েক দিনে এ আসনের বিভিন্ন এলাকার শতাধিক বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হয়েছে জাগো নিউজের। তাদের বেশিরভাগই অভিমত দিয়েছেন, রাজারবাগ ও শাহজাহানপুরের স্থানীয় বাসিন্দাদের বড় অংশের ভোট পাবেন মির্জা আব্বাস। কারণ মির্জা আব্বাস এ এলাকর স্থানীয় এবং বাসিন্দাদের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। অপরদিকে শান্তিনগর ও মালিবাগ এলাকায় রাশেদ খান মেননের অবস্থা বেশ শক্ত। এ এলাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পুরো সমর্থন পাচ্ছেন তিনি।
তবে স্থানীয় ভোটাররা এ আসনের প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারবে না। কারণ শান্তিনগর, মালিবাগ, রাজারবাগ, শাহজাহানপুর, মতিঝিল, পল্টন, কাকরাইল ও শাহবাগসহ সংসদীয় আসনটির সিংহভাগ ভোটারই ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা নয়। তাদের ওপরই প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নির্ভর করবে। আর ভাড়াটিয়া এসব ভোটারদের বেশিরভাগই ভোট দিবেন প্রতীকের ওপর নির্ভর করে। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তি ইমেজ থেকে দলীয় প্রতীকই প্রার্থীদের বড় সম্পদ।
শান্তিনগরের বাসিন্দা রিয়াদ হাসান বলেন, আমি ২০০৪ সাল থেকে শান্তিনগরে বাস করছি। বরিশালে গ্রামের বাড়িতে ভোটার না হয়ে এখানকার ভোটার হয়েছি। কারণ গ্রামের বড়িতে বছরে দুই-একবার যাওয়া পড়ে। সুতরাং ওখানে ভোটার হলে ভোট দেয়ার খুব একটা সুযোগ পেতাম না। সবকিছু বিবেচনা করে ঢাকায় ভোটার হয়েছি।
তিনি বলেন, ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। শান্তিনগর ও মালিবাগ অঞ্চলে যারা বসবাস করেন তাদের বেশিরভাগই ভাড়াটিয়া। ভোটারদের মধ্যে বাড়ির মালিকের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। আর যারা ভাড়াটিয়া তাদের বেশিরভাগই প্রতীক দেখে ভোট দিবেন।
Advertisement
সেগুনবাগিচার বাসিন্দা মো. রোমেল হাসান বলেন, প্রায় প্রতিদিনই নৌকার মিছিল শুনি। কিন্তু ধানের শীষের কোনো মিছিল এখনো শুনিনি। আমি এখানকার ভোটার হলেও কোনো বাড়ির মালিক না। তাই আমি কাকে ভোট দিব এটা প্রকাশ করতে চাই না। তবে আমি যতটুকু বুঝি এ এলাকার বেশিরভাগ ভোটারই মনে মনে ভোট দিয়ে আসবেন।
একই ধরনের কথা বলেন মতিঝিলের বাসিন্দা মো. আশরাফুল। তিনি বলেন, এবারের ভোট হবে খুবই ক্রিটিক্যাল। কে যে কাকে ভোট দিবে বোঝা মুশকিল। তবে মানুষের কথাবার্তায় বোঝা যায় নৌকা ও ধানের শীষের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। শান্তিনগর, মালিবাগ ও শাহবাগ এলাকায় নৌকা এবং শাহজাহানপুর, রাজারবাগ ও আরামবাগ এলাকায় ধানের শীষ এগিয়ে থাকবে বলে মনে যাচ্ছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে ঢাকা-৮ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন ওয়ার্কার্স পার্টির মেনন। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হাবিব-উন নবী খান সোহেলকে ৩০ হাজার ভোটে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ২০১৪ সালের বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে আবারও সংসদ সদস্য হন ওয়ার্কার্স পার্টির শীর্ষ এ নেতা।
অপরদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এবারই প্রথম ঢাকা-৮ আসন থেকে নির্বাচন করছেন। এর আগে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৬ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপির এ নেতা। তার আগে তিনি ১৯৯১ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
ঢাকা-৮ আসনের আগের সংসদ সদস্যরা
বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৮ থেকে ২১ নং ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা-৮ আসন। স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা-৮ আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কে এম শামসুল হুদা। আওয়ামী লীগের এ প্রার্থী ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন বিএনপির মো. আব্দুল হাই। এরপর ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ হারুন আর রশিদ ও ১৯৮৮ সালে আনোয়ার হোসেন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১২ বছর পর ১৯৯১ সালে আবারও ঢাকা-৮ আসন ফিরে পায় বিএনপি। ওই নির্বাচনে আসনটি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মীর শওকত আলী। আর ২৩ বছর পর ১৯৯৬ সালে ঢাকা-৮ আসন ফিরে পায় আওয়ামী লীগ। আসনটি থেকে নির্বাচিত হন পুরান ঢাকার জনপ্রিয় নেতা হাজী মোহাম্মদ সেলিম। তবে পাঁচ বছর পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পার্থীকে পরাজিত করে বিএনপির নাসিরুদ্দিন আহমেদ পিন্টু ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠন করে ঢাকা-৮ আসন থেকে বিএনপি মনোনিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটের লড়াইয়ে নামেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং প্রায় ৩৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেই থেকে টানা ১০ বছর ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে রয়েছেন তিনি।
এমএএস/এএইচ/পিআর