বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বাংলাদেশ টেলিভিশন। সংক্ষেপে এর পরিচিতি বিটিভি নামে। ২৫ শে ডিসেম্বর ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান টেলিভিশন নাম নিয়ে এর সম্প্রচার শুরু হয়।
Advertisement
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এটির নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ টেলিভিশন(বিটিভি) নামকরণ করা হয়। ১৯৮০ সাল থেকে বিটিভির রঙ্গিন সম্প্রচার শুরু হয়। শুরু হয় বিটিভির নতুন যাত্রা।
বর্তমানে এই স্যাটেলাইটের যুগে খেলা বা ইত্যাদির মতো বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া বিটিভিমুখি হতে চান না দর্শকরা। অথচ সাদাকালো যুগ থেকেই তুমুল জনপ্রিয় ছিলো বিটিভি। প্রায় ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়টাকে ধরা হয় বিটিভির সোনালী সময়।
একটা সময় ছিলো যখন মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর বিনোদনের মূল উপাদান ছিলো বিটিভি। বিশেষ করে সপ্তাহ শেষে ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে আরাম করে টিভি দেখার চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে ছিলো না। বিটিভিকে ঘিরে এক হতো পরিবারের সদস্যরা। পাড়া প্রতিবেশিরাও ভিড় করতেন টিভিওয়ালা বাড়িতে। আজও হয়তো সেইসব মধুর স্মৃতি অনেককেই হাতছানি দিয়ে যায়।
Advertisement
অতীতের সেই মুহুর্তগুলো স্যাটেলাইটের হাজারো বিনোদনের মাঝে আজ শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে। হারিয়ে গেছে বিটিভির সেই জৌলুস বা আবেদন। ক্রিকেটের কারণে মাঝেমাঝে চোখ রাখলেও বিটিভি এখন হাসি ঠাট্টার বিষয়।
এর কী কারণ? সেই উত্তরে প্রথমেই দায়ী করা হয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে। রাষ্ট্রীয় চ্যানেল হিসেবে বিটিভিকে সরকারের মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করা। গণতন্ত্রের দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই হয়েছে সরকারের পালা বদল। বিভিন্ন দল শাসন করেছে এই দেশ।
তারা তাদের মতাদর্শ, উন্নয়ন প্রচারের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিটিভিকে ব্যবহার করেছে। এতে একদিকে শিল্পী ও কর্মকর্তাদের দলীয়করণে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে বিটিভি। অন্যদিকে অতিমাত্রায় সরকারি প্রচারণায় বিরক্ত হয়ে বিটিভিবিমুখ হয়েছে দর্শক। অনেক ভালো অনুষ্ঠান বিটিভিতে প্রচার হলেও তার প্রতি আগ্রহ দেখান না দর্শক।
এর পাশাপাশি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে না পারা, দর্শকের চাহিদার মূল্যায়ণ করতে না পারা, বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা ইত্যাদি কারণে বিটিভি তার আবেদন হারিয়েছে বলে মনে করা হয়।
Advertisement
আলোচনায় আসে ৯০’র দশকে কি এমন ছিলো যা বিটিভি দেখতে বাধ্য করতো সবাইকে! উত্তর হিসেবে উঠে আসে বিটিভির বেশ কিছু আকর্ষণীয় আয়োজনের নাম। বিটিভির জন্মদিনে সেইসব অনুষ্ঠানে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক-
বাংলা চলচ্চিত্রসবাই আঙুলের কড়ে গুনে কাটাতেন ছয়টি দিন- কবে হবে শুক্রবার। কারণ, ওইদিন বিটিভিতে প্রচার হবে বাংলা চলচ্চিত্র। তখন প্রতি শুক্রবার দুপুর ৩টা ২০ মিনিটে প্রচার হতো বাংলা চলচ্চিত্র। সেই সময়ে দুপুরের খাবার শেষে সবাই জট পাকিয়ে বসতেন হোম থিয়েটারের পরিবেশে। অনেকেই আয়োজন করতেন নানারকম খাবারও।
গ্রামে গঞ্জে ব্যাটারি দিয়ে টিভি দেখা হতো। দেখা যেত টিভি আছে এক বাড়িতে। কিন্তু সেই টিভি চালানোর ব্যাটারি চার্জ করানো হতো পাড়া প্রতিবেশিদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে। সবাই এক টাকা, পাঁচ টাকা করে চাঁদা দিতেন শুক্রবারের সিনেমা দেখার জন্য। এ ছিলো অন্যরকম এক উৎসব।
ছায়াছন্দবিটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিলো ছায়াছন্দ। বাংলা ছবির গান নিয়ে সাজানো এই অনুষ্ঠানে প্রচার হতো নতুন পুরোনো ছবির গান। তুমুল জনপ্রিয় ছিলো অনুষ্ঠানটি।
ইত্যাদিহানিফ সংকেতের পরিচালনা ও উপস্থাপনায় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি ছিলো বিটিভির সফল একটি আয়োজন। কৌতুকের আড়ালে বৈচিত্রময় শিক্ষামূলক নাটিকা, গান, তারকাদের উপস্থিতি আর হানিফ সংকেতের প্রাণবন্ত উপস্থাপনাই ছিলো অনুষ্ঠানটির প্রাণ।
এই ইত্যাদি বহু তারকার আবিষ্কারক। এমনকি আজকের জনপ্রিয় গায়ক আসিফ আকবরের উত্থানও বলা চলে ইত্যাদি দিয়ে। ফোঁক গানের গায়ক পথিক নবীও এই অনুষ্ঠানে গেয়েই পরিচিতি পেয়েছিলেন। সময়ের স্রোতে বিটিভির সেই জনপ্রিয়তা আর না থাকলেও এখনও অনেকেই সময় হলে বিটিভিতে ঢুঁ মারেন ইত্যাদি প্রচারের খবর শুনলে।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকবাংলা নাটকের ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার অসংখ্য জনপ্রিয় নাটক ছিলো বিটিভির জনপ্রিয়তার বিরাট উপাদান। বিশেষ করে অয়োময়, এইসব দিনরাত্রি, নক্ষত্রের রাত, বহুব্রিহী, সবুজ ছায়া ধারাবাহিক নাটকগুলো দেশব্যাপি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
আর ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাই চরিত্র দিয়ে সারা দেশে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। সেই নাটকে নির্দোষ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি মেনে নিতে পারেননি দর্শকেরা। তাই নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ যাতে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি না দেন সেজন্য মিছিল করেছিলো দেশের মানুষ।
সে এক যুগান্তকারী ইতিহাস। যার সঙ্গে চিরকাল মিশে থাকবে হুমায়ূন আহমেদ, বাকের ভাই চরিত্রের অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর ও বিটিভির নাম।
অন্যান্য নাটকবিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদ ছাড়াও বহু নাট্যকার ও পরিচালক নাটক দিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। মুগ্ধ করে রেখেছিলেন দর্শক। সেইসব মানুষদের নাটকের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য প্যাকেজ নাটক। ধারাবাহিকের মধ্যে উল্লেখ করা যায় ‘সকাল-সন্ধ্যা’, ‘রুপনগর’, ‘বারো রকম মানুষ’ ইত্যাদি।
শুভেচ্ছা ও আনন্দমেলাইত্যাদির মতো আরও দুটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দর্শকের মনে দাগ কেটেছিলো। তারা দিন গুনতেন কবে আসবে এই অনুষ্ঠান দুটির প্রচারের দিন। তার একটি হলো আব্দুন নূর তুষারের উপস্থাপনায় ‘শুভেচ্ছা’। আর একটি ছিলো তারকাদের ভরপুর উপস্থিতির অনুষ্ঠান ‘আনন্দমেলা’।
আলিফ লায়লানব্বই দশকের বিটিভির অনুষ্ঠানের সূচি করতে গেলে ‘আলিফ লায়লা’ অনুষ্ঠানটিকে বাধ দেয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়। আরব্য রজনীর কাহিনী নিয়ে নির্মিত এই টিভি সিরিজটি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলো।
আজও হয়তো কেউ কেউ হয়তো ‘আলিফ লায়লা’র চরিত্রগুলোর কথা চিন্তা করে হেসে ফেলেন। আলিফ লায়লা শিরোনামে গানটিও ছিলো এর দর্শকদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়।
এক্স-ফাইলসএক্স-ফাইলের মতো জনপ্রিয় বিদেশি টিভি সিরিয়ালগুলো বাংলা ভাষায় ডাবিং করে সম্প্রচার করা হতো। অনেকেই তখন শখের বশে ‘এক্স ফাইলস’র বিখ্যাত উক্তি ‘দ্য ট্রুথ ইজ আউট দেয়ার’ লাইনটি বন্ধুদের আড্ডা বা গল্পের সময় বলে থাকতেন।
ম্যাকগাইভারবাংলাদেশে এক সময় একটি অস্ত্রের নামই ছিলো ‘ম্যাকগাইভার চাকু’। যা মূলত সুইস আর্মির ব্যবহৃত চাকু হিসেবেই দেখানো হয়েছিলো জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ম্যাকগাইভার। নব্বই এর দশকের এমন কোন লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর যে কিনা ‘ম্যাকগাইভার’ দেখেনি। তারই প্রভাব পড়েছিলো সবখানে। সেখান থেকেই বোঝা যায় কত জনপ্রিয় ছিলো এই সিরিয়াল। আর সেটি প্রচার করে কতোটা জনপ্রিয়তায় ছিলো বিটিভি!
রোবোকোপঅর্ধেক মানব আর অর্ধেক ম্যাশিন। এই অদ্ভুত মানবের নামই ছিলো রোবোকোপ। বাংলাদেশের অনেকেই ১৯৮৭ সালে মুক্তি প্রাপ্ত রোবোকোপ ছবিটি দেখেননি। তাদের কাছে তখন টিভি সিরিয়াল হিসেবে পরিচিত এই রোবোকোপ সিরিজটিই ছিলো একমাত্র আনন্দের উৎস।
রবিন হুডনব্বই এর দশকের তরুনীগন রবিন হুডের স্বপ্নে বিভোর থাকতেন। আর তরুণদের মাঝে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি রাখার রীতির প্রচলন শুরু হয়। তৎকালীন সময়ে বিটিভিতে প্রচারিত হওয়া জনপ্রিয় টিভি সিরিজগুলোর একটা ছিলো রবিনহুড।
হারকিউলিসআলিফ লায়লার পর বিটিভির দর্শকদের কাছে হারকিউলিস ছিলো তুমুল জনপ্রিয়। হারকিউলিসের অতিমানবীয় কাজ কর্ম মুগ্ধ হয়ে দেখতো বাংলাদেশি দর্শকরা। রূপকথা আর একশনের মিশ্রনে অসাধারণ এক টিভি সিরিয়াল ছিলো হারকিউলিস।
সিন্দাবাদআরব্য রজনির আরেক জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ছিলো সিন্দাবাদ। সাগরেরে গুপ্তধন আর জলদস্যুদের কল্পকাহিনী নিয়ে নির্মিত সিরিজটি সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটির দিনে প্রচার করা হতো টিভিতে।
ক্যাপ্টেন প্ল্যানেটঅনেকের কাছেই দুপুরবেলার ঘুম ফেলে চুরি করে মঙ্গলবার বিটিভি দেখার কারণ ছিল ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট। ইংরেজি না বুঝলেও দর্শকরা মুগ্ধ! কার্টুন এমন এক ধরনের শিল্প, যেখানে ভাষা কোনো বাধাই নয়। আর ‘ক্যাপ্টেন প্ল্যানেট’ কার্টুনটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো শিশু-কিশোরদের কাছে।
গডজিলা, সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, থান্ডারক্যাটসজনপ্রিয় ছিলো গডজিলা, সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, থান্ডারক্যাটস সিরিজগুলোও। কিশোরদের কাছে এই তিনটি অনুষ্ঠানের জন্য বিটিভি ছিলো স্বপ্নে পাওয়া স্বর্গের মতোই। অভিভাবকরাও এইসব সিরিজ দেখতে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আদায় করে নিতেন পড়াশোনা।
ব্যান্ড শোসত্তর দশকের পর থেকেই বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের রাজকীয় উত্থান বলা চলে। তখন থেকেই বিটিভিতে প্রচার শুরু হয় ব্যান্ড সংগীতের অনুষ্ঠান। যুব সম্প্রদায়ের কাছে ব্যান্ডের গান নিয়ে হওয়া এই অনুষ্ঠানগুলো ছিলো খুবই জনপ্রিয়। নানা রকম ব্যান্ড শো দিয়ে গণমানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে অনেক বড় বড় ব্যান্ড দল।
নতুন কুঁড়ি১৯৭৬ সালে বিটিভিতে জাতীয়ভাবে মেধা অনুসন্ধানে জন্য মোস্তফা মনোয়ারের নির্দেশনায় ‘নতুন কুঁড়ি’ নামে প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। খুবই জনপ্রিয় ছিলো এই অনুষ্ঠানটি।
এছাড়াও বিটিভির শুরুর দিকে তুমুল জনপ্রিয় ছিলো ফজলে লোহানীর উপস্থাপনায় ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানটি। বিটিভিকে জনপ্রিয়তা দিয়েছিলো মীনা কার্টুন, মাটি ও মানুষ, সুর লহরী, মালঞ্চ, বিশের বাঁশি আর পছন্দের মনের কথা নামের অনুষ্ঠানগুলোও।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আজকাল স্যাটেলাইট চ্যানেলে যে বিজ্ঞাপন বিরক্তিতে মাথা ধরায় বিটিভির সোনালি দিনে সেই বিজ্ঞাপন এমন ছিলো না। তখনকার বিজ্ঞাপনগুলোও ছিলো বেশ উপভোগ্য। নামি দামি তারকাদের নিয়ে গল্প নির্ভর বিজ্ঞাপনগুলোও বিনোদন দিতো দর্শকদের।
এলএ/এমএস