আন্তর্জাতিক

যিশু আসলে দেখতে কেমন ছিলেন?

সবাই জানেন যিশু দেখতে কেমন ছিলেন। পশ্চিমা চিত্রকলায় সবচেয়ে বেশি আঁকা হয়েছে তার ছবি। ফলে সবারই পরিচিত তার চেহারা- লম্বা চুল, দাড়ি, লম্বা হাতাওয়ালা আলখাল্লা (সাধারণত সাদা), আর একটি চাদর বা শাল (সাধারণত নীল)। কিন্তু আসলেই কি যিশু দেখতে এ রকম ছিলেন?

Advertisement

সম্ভবত, না। প্রকৃতপক্ষে যিশুর যে চেহারার সাথে আমরা পরিচিত তার উৎস বাইজান্টাইন যুগে -চতুর্থ শতাব্দী বা তার পরবর্তীকালে। এবং বাইজান্টাইন যুগের এই যিশুর চেহারা সম্পূর্ণই প্রতীকী। এর কোনো ঐতিহাসিক নির্ভুলতা নেই। এগুলো মূলত আঁকা হয়েছিল সিংহাসনে বসা একজন সম্রাটের চিত্রকল্পকে ভিত্তি করে -যেমনটা আমরা রোমের সান্তা পুডেনজিয়ানা গীর্জার বেদীতে দেখি।

সম্রাটের মতো দেখতে যিশুছবিতে দেখা যাচ্ছে যিশুর পরনে সোনালী টোগা (প্রাচীন রোমান পোশাক), তাকে চিত্রিত করা হয়েছে সারা বিশ্বের শাসক হিসেবে। তার সাথে অনেক মিল আছে সিংহাসনে বসা লম্বা চুলদাড়িওয়ালা অলিম্পিয়ান দেবরাজ জিউসের সাথে।

এই প্রতিমূর্তি সে যুগে এতই পরিচিত ছিল যে, রোমান সম্রাট অগাস্টাস একই স্টাইলে তার নিজের একটি মূর্তি তৈরি করিয়েছিলেন -অবশ্য তাতে তার দেবতাদের মত লম্বা চুলদাড়ি ছিল না।

Advertisement

বাইজান্টাইন শিল্পীরা যীশুখ্রিস্টকে স্বর্গীয় ক্ষমতাসম্পন্ন মহাবিশ্বের রাজা হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন। তাই তারা তাকে তৈরি করেন দেবরাজ জিউসের এক তরুণতর সংস্করণ হিসেবে। কালক্রমে সেই স্বর্গীয় আদলে সৃষ্ট যিশুর চেহারা কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে অনেকটা হিপিদের মত এক নতুন রূপ পায়।সেটাই হয়ে দাঁড়ায় কল্পিত যিশুর চেহারার স্ট্যান্ডার্ড মডেল।

কিন্তু আসল যিশু কি এ রকমই দেখতে ছিলেন? বা তার আসল চেহারা কেমন ছিল? আমরা পা থেকে মাথা পর্যন্ত সবই পরীক্ষা করে দেখি।

মাথা এবং চুলপ্রথম যুগের খ্রিস্টানরা যিশুকে স্বর্গীয় শাসক হিসেবে চিত্রিত করতেন না। তারা তাকে দেখাতেন একজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই, ছোট চুলওয়ালা এবং দাড়িবিহীন। তবে সম্ভবত একজন পরিব্রাজক সাধু হিসেবে যিশু হয়তো দাড়ি রেখেছিলেন, এ কারণেই তার নাপিতের কাছে যাওয়া হতো না।

তখনকার দিনে একজন দার্শনিককে চেনা যেত তার উস্কোখুস্কো চেহারা-পোশাক আর দাড়ি দেখে। অন্যদিকে প্রথম শতাব্দীর গ্রেকো-রোমান বিশ্বে দাড়ি কামানো এবং ছোট চুল রাখাটা ছিল আবশ্যিক। লম্বা চুল-দাড়ি ছিল দেবতাদের জিনিস, পুরুষদের ফ্যাশন নয়। এমনকি সে যুগে দার্শনিকরাও ছোট চুল রাখতেন। তখনকার দিনে একজন ইহুদিকেও দাড়ি দিয়ে চেনা যেত না।

Advertisement

ইহুদিদের ওপর নির্যাতনকারীদের একটা সমস্যা ছিল তাদের চেনা -কারণ তারা ছিল অন্য সবার মতোই দেখতে। তবে ৭০ খ্রিস্টাব্দে জেরুসালেম দখলের পর রোমের মুদ্রায় যে ইহুদিদের দেখা যায়, তাতে বন্দিদের মুখে দাড়ি আছে। যিশু যে একজন ইহুদি (জুডিয়ান) ছিলেন, এটা বহুবার নানাভাবে উল্লিখিত হয়েছে। কাজেই এমন হতে পারে যে যিশুর হয়তো তেমনি ছোট দাড়ি ছিল, তবে তার চুল হয়তো খুব একটা লম্বা ছিল না।

যিশুর কাপড়-চোপড়সে সময় ধনী লোকেরা তাদের উচ্চ পদমর্যাদা দেখাতে লম্বা আলখাল্লা পরতেন। যিশু হয়তো এ রকম কাপড় পরতেন না -কারণ তিনি এ ধরনের লোকদের থেকে সতর্ক থাকতে উপদেশ দিয়েছেন।

সাধারণত সে সময় পুরুষরা হাটু পর্যন্ত লম্বা ‘চিতন’ পরতেন, মেয়েরা পরতেন গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা পোশাক। যিশু এর ওপর একটা হিমেশন বা শাল পরতেন -যার বর্ণনা পাওয়া যায়। এই শালের মান, আকার এবং রং থেকে পরিধানকারীর ক্ষমতা এবং সম্মান বোঝা যেত। সন্ত মার্ক যিশুকে বর্ণনা করেছেন রঙ না করা সাধারণ কাপড় পরা সাধারণ মানুষ হিসেবে।

 

যিশুর জুতাসে যুগে সবাই চপ্পল বা স্যান্ডাল পরতেন। সেগুলো ছিল খুবই সহজ কায়দায় বানানো। এর তলা বা ‘সোল’টা ছিল কয়েক স্তর চামড়া জোড়া দিয়ে বানানো, আর ওপরের দিকটা চামড়ার সরু ফিতে দিয়ে তৈরি হতো। যিশুও হয়তো এ রকম চপ্পলই পরতেন।

যিশুর মুখের গড়ন কেমন ছিল?যিশু যে একজন ইহুদি ছিলেন তা বহুভাবে সে সময়ের অনেকে উল্লেখ করেছেন। তার ধর্মপ্রচারক হিসেবে যাত্রা শুরু করার সময় বয়েস ছিল ৩০-এর মতো।

সে যুগের ইহুদিরা কেমন দেখতে ছিলেন?

বিবিসির একটি প্রামাণ্যচিত্রের জন্য ২০০১ সালে যিশুর মুখের একটি আনুমানিক প্রতিরূপ তৈরি করেন নৃতত্ববিদ এডওয়ার্ড নীভ। গালীলী অঞ্চলে পাওয়া একটি মাথার খুলির ওপর ভিত্তি করে এটা তৈরি করেন তিনি। তবে তিনি দাবি করেননি যে যিশু এ রকমই দেখতে ছিলেন। তিনি শুধু একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করেন যে, সে যুগে ওই এলাকার লোকেরা সাধারণভাবে দেখতে কেমন ছিলেন।

কারণ যিশু যে ব্যতিক্রমী চেহারার কেউ ছিলেন এটা কেউই বলেননি। তার নীল চোখ ছিল এমন সম্ভাবনাও খুব কম। যিশু ঠিক কেমন দেখতে ছিলেন -তার হয়তো সবচেয়ে কাছাকাছি ধারণা পাওয়া সম্ভব দুরা-ইউরোপোসে তৃতীয় শতকের সিনাগগে নবী মুসার ছবি থেকে।

কারণ গ্রেকো-রোমান যুগে একজন ইহুদি সন্তের চেহারার কেমন ছিল -তার ধারণা এখানে পাওয়া যায়। এখানে নবী মুসার ছোট চুল, ছোট দাড়ি, খাটো হাতের হাঁটু-অবধি আলখাল্লা, হিমেশন বা শাল -সবকিছু মিলিয়ে বলা যায় -তার চেহারার সাথে ঐতিহাসিক যিশুর মিল থাকার সম্ভাবনা বাইজান্টাইন যুগের যিশুর ছবির চাইতে অনেক বেশি।

লেখক : জোয়ান টেলর (তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে খ্রিস্টধর্মের উৎস এবং দ্বিতীয় মন্দিরের যুগের ইহুদিধর্ম বিষয়ক অধ্যাপক এবং লেখক)। সূত্র : বিবিসি

আরএস/জেআইএম