বিশেষ প্রতিবেদন

জামায়াতকে দূরে রাখলে ঐক্যফ্রন্টের গণজোয়ার সৃষ্টি হতো

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ। লিখছেন সমাজ, রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে।

Advertisement

নির্বাচন এবং রাজনীতি নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বিচ্যুতি ঘটার কারণেই আজকের রাজনীতির সঙ্কট বলে মনে করেন। সংস্কৃতির বিকাশ না হওয়ায় ডানপন্থী রাজনীতি সমাজে প্রভাব ফেলছে বলে মত দেন। আসন্ন নির্বাচন ব্যর্থ হলে সঙ্কট আরও বাড়বে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন এ বিশ্লেষক। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হলো আজ।

জাগো নিউজ : স্বাধীনতার ৪৮ বছরে বাংলাদেশ। নির্বাচন, ভোট প্রশ্নে কোথায় দাঁড়ালো জাতি?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : দ্বন্দ্বমুখী অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। ভোট, নির্বাচন প্রশ্নে দু’টি বড় দলের লড়াই চলছে। ভোটের মাধ্যমে সে লড়াই যতটা না হয়, তার চেয়ে বেশি হয় কথাবার্তায়। আর দ্বন্দ্ব সংঘাতে রূপ নিচ্ছে বছরের পর বছর ধরে।

Advertisement

সামনের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার সংঘাতকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমরা সংঘাত ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। বিরোধী দলের প্রচারে বাধা দেয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন নিষ্ক্রিয় থেকেও শান্তিপূর্ণ ভোটের আশ্বাস দিচ্ছে। সব মিলিয়ে আমার কাছে মনে হচ্ছে, নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ নাও হতে পারে।

অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ এ তিনটি বিষয় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অংশগ্রহণমূলক হলেই নির্বাচন অবাধ হয় না। ভোটাররা নিজের ভোট দিতে পারবেন কী-না তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে।

তবে আমি আশাবাদী মানুষ। সেনাবাহিনী নামায় ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। সরকারবিরোধী জোট প্রচার চালাতে পারলে নির্বাচন একতরফা নাও হতে পারে।

জাগো নিউজ : অভিযোগ উঠছে, পুলিশ নৌকা প্রতীকের পক্ষে ভোট চাইছে। এ বিষয়গুলো কীসের ইঙ্গিত বহন করে?

Advertisement

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ হয় না- তারই ইঙ্গিত বহন করছে। প্রশাসনের অনেকেই দীর্ঘদিন চাকরিতে থাকবেন। তারা সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে চাইছে।

সরকার থেকেও প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হতে পারে নৌকার পক্ষে অবস্থান নিতে, অথবা প্রশাসন থেকেই উৎসাহী হয়ে তৎপর হতে পারে।

জাগো নিউজ : প্রশাসনকে আগে এভাবে ব্যবহার হতে দেখা যায়নি?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : সরকার আবারও ক্ষমতায় আসতে বদ্ধপরিকর। ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী। এ দুটি ঘটনা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ।

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী যদি এমনটি একটি সরকার উদযাপন করে, যেখানে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিও আছে এবং এটি আওয়ামী লীগের কাছে শঙ্কার কারণ। এ কারণে আওয়ামী লীগ যেকোনো কৌশলেই ক্ষমতায় থাকতে চাইবে। ভোট নিরপেক্ষ হলে ক্ষমতায় আসা অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। এ কারণেই দুর্বল প্রার্থির অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে প্রশাসনকে ব্যবহার করা হতে পারে। এ অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না।

জাগো নিউজ : তাহলে ‘চেতনা’র প্রসঙ্গও আসে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : অংসখ্য তরুণ এখন পুলিশ অফিসার। যাদের একাত্তর ভুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারা এখন নতুন করে একাত্তরকে অনুধাবন করছে। আমার দুঃখ হচ্ছে বিএনপি কেন এটি অনুধাবন করতে পারছে না? বিএনপি এখনও ২০০১ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাইছে কেন?

২০১৪ সালের পর বিএনপির বোঝা উচিত ছিল ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তরুণদের আকাঙ্ক্ষা কী? অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের ছুড়ে ফেলা সময়ের দাবি ছিল। তাহলে হয়তো আজকের পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। আদর্শগত কারণেই প্রশাসনের অনেক তরুণ অফিসার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে চাইবে। ২০২১ সালে তরুণ অফিসাররাও হয়তো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে দেখতে চাইছে।

জাগো নিউজ : আমরা জবরদস্তির নির্বাচন দেখছি। এভাবে ক্ষমতায় গিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করে আসলে কী চেতনা দাঁড় করানো যায়!

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : একাত্তরের চেতনা নিয়ে আসলে জোর করা ঠিক না বলে আমি মনে করি। এটিকে কে ধারণ করলো আর কে করলো তা নিয়ে জুলুম করা ঠিক নয়।

অনেক তরুণ একাত্তরকে অহঙ্কারের সঙ্গে মেনে নিতে পারছে না। অনেক তরুণ ১৯৭১ এবং আওয়ামী লীগকে এক করে ফেলছে।

জাগো নিউজ : এরও তো কারণ আছে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : হয়তো আওয়ামী লীগের অতি বাড়াবাড়ির কারণেই তরুণদের মধ্যে এমন পরিবর্তন। এ দায় সবার। একটি দল বাড়াবাড়ি করলেই তো আমার চেতনাকে বিসর্জন দিতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধ সবার। একটি বিশেষ দল দাবি করে বসলেই তার হয়ে যায় না। আমার তো বোঝা উচিত।

মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের বাইরেও অনেক শক্তি ছিল। এটি কেন আমি বুঝতে পারছি না? তাহলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার পড়াশোনা কোথায়?

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তাদের অবদান আছে। তাই বলে আমি আওয়ামী লীগের এখনকার কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করতে গিয়ে তো স্বাধীনতাবিরোধীদের ওপর ভরসা রাখতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি বিএনপি দাবি করত, তাহলে আমি সবচেয়ে খুশি হতাম। কিন্তু বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

সুতরাং জবরদস্তির প্রশ্ন তুলে চেতনার বিষয়টিকে হালকা করার সুযোগ নেই। ১৯৭১ সালকে নিজের মতো করে নিতে না পারা হচ্ছে অসুখের বিষয়।

জাগো নিউজ : চেতনা দাঁড় করানোর চেষ্টাও তো হলো। অথচ আপনি বলছেন, তরুণদের অনেকেই এখন ‘১৯৭১’কে অহঙ্কারের সঙ্গে স্বীকার করে না।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : মূলত শিক্ষার অভাবেই চেতনা দাঁড় করানো যায়নি। আবার সরকারগুলো রাষ্ট্রের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ায় চেতনা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিরোধ-প্রতিবাদ করার ক্ষমতা মানুষ হারিয়ে ফেলছে। এখানেও রাষ্ট্র নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ওয়াজ-মাহফিল এবং ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ক্রমাগত মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শক্তি জুগিয়েছে। মাদ্রাসাগুলো কখনোই সাংস্কৃতিক শিক্ষা দিতে রাজি হয়নি। তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে যেভাবে প্রবেশ করেছে, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি তার কিছুই করতে পারেনি।

১৯৭৫ সালের পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে, যাতে তরুণরা সত্যটি জানতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। স্বাধীনতাবিরোধীরা তৃণমূলে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে, যা বিভ্রান্ত তরুণদের আকৃষ্ট করেছে। সংস্কৃতি থেকে তরুণদের বিমুখ করে ফেলা হয়েছে। খেলাধুলা নেই। মুখস্থ বিদ্যায় শিক্ষার্থীদের আটকে ফেলা হচ্ছে। সংস্কৃতি ছাড়া একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি হতে পারে না। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পাঠ্যবই এমনভাবে উপস্থাপন করা হলো যে, কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে সেই বিতর্ক সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল।

জাগো নিউজ : এ দ্বান্দ্বিক-সংস্কৃতিহীন সমাজ বিনির্মাণে সুশীল-বুদ্ধিজীবীদেরও দায় আছে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : হ্যাঁ, দায় আমাদেরও আছে। আমরা সঠিকভাবে অগ্রসর হতে পারিনি। রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্যা থাকবেই। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের তো সঠিক পথে এগুনোর কথা ছিল। বিভাজনের সমাজ সৃষ্টিতে বুদ্ধিজীবীদের দায় আছে।

তবে চিন্তার জায়গায় সবচেয়ে ক্ষতি করেছে সামরিক শাসন। সামরিক এবং ছদ্মবেশী সামরিক শাসনে সমাজে সাধারণ মানুষের সক্রিয়তা অনেক কমে গেছে। আর মানুষকে নিষ্ক্রিয় করতে একটির পর একটি আইন করা হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য-প্রযুক্তি আইনে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আরও খর্ব করা হয়েছে। তার মানে স্বাধীনতার পক্ষের দাবিদার যখন এমন একটি আইন করে, তখন বুঝতে হবে অসুখটা রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্রই বিরাজ করছে।

আমরা যারা নিজেদের নাগরিক সমাজের সভ্য বলে দাবি করি, তাদের নিষ্ক্রিয়তায় সংস্কৃতি নিয়ে আজকের এ উদাসীনতা।

জাগো নিউজ : স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ টানা দশ বছর ক্ষমতায়। এ সময় তো সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানোর কথা ছিল?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আওয়ামী লীগও এখন স্বাধীতার চেতনা পুরোপুরি ধারণ করে, তা বলা যাবে না। কারণ তারাও ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি একেবারে ছুড়ে ফেলে দেয়নি। তারা এখনও ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আঁতাত করছে। প্রকৃত ইসলাম আর প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামের মধ্যে তফাত তুলে ধরছে না। আওয়ামী লীগের অনেক কর্মকাণ্ডে একাত্তরের চেতনা আর প্রতিফলিত হচ্ছে না। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো হচ্ছে। এটি তো আর বিভাজিত বিষয় নয়। এটি সামগ্রিক একটি বিষয়।

আওয়ামী লীগ যদি দুর্নীতি নির্মূল, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারত, তাহলে বলতাম তারা স্বাধীনতার পক্ষে আছে। আওয়ামী লীগ বাকস্বাধীনতা হরণ করছে। ফলে একাত্তরের চেতনা শতভাগ বাস্তবায়ন করতে পারবে এ দলটি, আমি তা মনে করতে পারছি না।

জাগো নিউজ : তাহলে কী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে আওয়ামী লীগই বেশি ক্ষতি করলো?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমি ঠিক সেভাবে বলছি না। কারণ এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এ চেতনা ধারণ করে রাজনীতি করছে বলে সাধুবাদ জানাই। অনেকেই সরে গেল। চরম বামপন্থীরাও মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করছেন। তারা যে রাষ্ট্র চেয়েছে, তাতে একাত্তর গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।

অন্যদিকে ডানপন্থীরা তো মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করেই রাজনীতি করছে। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষেরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধটাও তারাই করেছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক ইতিহাস আমরা লিখতে পারিনি। শহরকেন্দ্রিক, প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ইতিহাস চর্চা হচ্ছে।

আর এ চর্চা তীব্র হয়েছে ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। পঁচাত্তর সালের পর বিশেষ ভূমি তৈরি করে বিএনপি রাজনীতি করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও সেই জায়গা থেকেই বিএনপি অগ্রসর হচ্ছে।

ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়ার আগে আমরা ভেবেছিলাম বিএনপি তার অবস্থান পরিবর্তন করবে। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে বিএনপির মধ্যে পরিবর্তন আসবে। তা আসেনি। জামায়াতকে দূরে রাখলে হয়তো ঐক্যফ্রন্টের বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে গণজোয়ার তৈরি হতো। তরুণরাও সেখানে সম্পৃক্ত হতো। এ সুবিধাটা বিএনপি হেলায় হারিয়েছে।

জাগো নিউজ : একটি চেতনা ধারণ করে রাজনীতি করা হচ্ছে মানুষের ইচ্ছার ব্যাপার। জোর করে মত প্রতিষ্ঠা করা যায় না। আওয়ামী লীগ এখন যা করছে, তাতে হিতে বিপরীত হচ্ছে কী-না?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : হিতে বিপরীত হওয়ার বিষয় নয়। আওয়ামী লীগকে তো শেষ করে দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ না থাকলে আমাদের এখন ডানপন্থার চর্চা করা লাগতো। বাংলাদেশ একটি পুলিশি রাষ্ট্র হতো।

জাগো নিউজ : অভিযোগ উঠেছে বরং এখনই ‘পুলিশি রাষ্ট্র’প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : সে অভিযোগ আছে। কিন্তু আমি অন্তত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অহঙ্কার করতে পারি।

এএসএস/এনডিএস/এমএস