যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা মনে করে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে তারা মঙ্গলে মানুষ পাঠাতে সক্ষম হবে। তবে এর আগে প্রযুক্তিগত ও স্বাস্থ্যজনিত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে হবে বলে মনে করে সংস্থাটি।
Advertisement
তবে নাসার সেই উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করেছেন এক নভোচারী। এই নভোচারীর মতে, মঙ্গলে মানুষের পাড়ি জমানোর প্রচেষ্টা নেহাত বোকামি ছাড়া আর কিছু নই। এমনকি মঙ্গলে নভোচারী পাঠানোর উদ্যোগকে হাস্যকর বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
এই নভোচারী আর কেউ নন-বিল অ্যান্ডার্স। চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি জমানো প্রথম মহাকাশচারী যান অ্যাপোলো-৮-এর পাইলট। সম্প্রতি বিবিসি রেডিও ৫ এর একটি সরাসরি সম্প্রচার অনুষ্ঠানে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
তবে বিল অ্যান্ডার্সের এ বিরূপ মন্তব্যের পর নাসার পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
Advertisement
৮৫ বছর বয়সী অ্যান্ডার্স নিজেও একজন মঙ্গল মিশনের পক্ষে। তবে সেই মিশনটা হতে হবে মনুষ্যবিহীন। কারণ তিনি মনে করেন, মঙ্গলে মনুষ্যবিহীন যান পাঠানো তুলনামূলক কম খরচের। তবে মঙ্গলে মানুষ পাঠানো খুবই ব্যয়বহুল। আর এই খরচ জনসাধারণের পক্ষে ব্যয় করা কষ্টকর।
‘মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর যৌক্তিকতা কোথায় আর আমরা কেনই বা সেখানে যাচ্ছি? আমি মনে করে, এখানে জনগণের কোনো স্বার্থ জড়িত নেই। এমনকি আমার তো মনে হয়, জনসাধারণও এটা চায় না’-যোগ করেন অ্যান্ডার্স।
তবে অ্যান্ডার্স মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর বিরোধিতা করলেও কিন্তু লালবর্ণের গ্রহটিতে নাসার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রোবটিক যান অনুসন্ধান চালাচ্ছে গ্রহটিতে। গত মাসে সফলভাবে অবতরণ করেছে ধীরগতির অবতরণ ক্ষমতাসম্পন্ন রোবটযান ‘ইনসাইট’।
মঙ্গলের ভূমিকম্পের তথ্য থেকে গ্রহটির অভ্যন্তরীণ কাঠামো সম্পর্কে ধারণা পেতেই নাসার এই মিশন। অবতরণের পর সেখানকার মাটিতে সিসমোমিটার (কম্পনমাপক যন্ত্র) স্থাপনের পর থেকেই তথ্য পাঠাতে শুরু করেছে ইনসাইট ল্যান্ডার।
Advertisement
সিসমোমিটারে যুক্তরাজ্যের তৈরি একটি সেন্সরও রয়েছে। এটিই বিজ্ঞানীদের মঙ্গলের ভূমিকম্প ‘মার্সকোয়াক’ সম্বন্ধে তথ্য দেবে। মঙ্গলপৃষ্ঠ থেকে ১৬ ফুট গভীর পর্যন্ত খুঁড়তে সক্ষম ইনসাইট ল্যান্ডার। পৃথিবীর সঙ্গে তুলনার পর মিলবে মঙ্গলের অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে থাকা পাথরের স্তর সংক্রান্ত তথ্যও।
১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে ফ্লোরিডার অ্যাটপ অ্য স্যাটার্ন ভি থেকে ফ্রাঙ্ক বোরম্যান ও জিম লভেলের সঙ্গে চাঁদের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান বিল অ্যান্ডার্স। তারা উপগ্রহটির কক্ষপথে ২০ ঘণ্টা কাটিয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন।
তবে তাদের পৃথিবীতে ফিরে আসাটা শুভকর ছিল না। ২৭ ডিসেম্বর ফেরার পথে নির্দিষ্ট গন্তব্যে প্রায় সাড়ে চার হাজার মিটার দূরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ছিটকে পড়ে মহাকাশযানটি। পরে ইউএসএস ইয়র্কটাউনে করে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অ্যাপোলো-৮ এর অভিযান শেষে ৭ মাস পরে চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি জমায় মহাকাশযান অ্যাপোলো-১১।
নাসার সমালোচনা করে সাবেক এই নভোচারী বলেন, ‘নাসা আজও চাঁদকে জয় করতে পারেনি। চাঁদকে যেভাবে পাওয়ার কথা ছিল সেভাবে তারা এটিকে এখনও পায়নি। এটা তাদের জন্য আরও কঠিন কাজ।’ এ ছাড়া চন্দ্রাভিযানের পর থেকে নাসা মহাকাশে মানুষ পাঠানো নিয়ে জগাখিচুরি পাকিয়ে ফেলেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ব্যক্তিগতভাবে মঙ্গলে অভিযান পাঠানোর চেষ্টা চালাচ্ছে স্পেস এক্স প্রতিষ্ঠাতা এলন মাস্ক ও অ্যামাজন বস জেফ বেজোস। এ প্রসঙ্গে তার কাছে জানতে চাইলে বিবিসি রেডিও ৫-কে তিনি বলেন, ‘মঙ্গল নিয়ে আজেবাজে কথা বলে অনেকে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন যার সবই অর্থহীন। মাস্ক ও বেজোস যে বলছেন তারা মঙ্গলে কলোনি স্থাপন করছেন তা-ও ভিত্তিহীন কথা।’
অ্যান্ডার্স আরেক ধাপ এগিয়ে কৌতুকের স্বরে বলেন, ‘আমি তো মনে করি মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর মিশন গ্রহটিকে পিছনে ফেলে মহাকাশচারীদের ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকবে, এর বেশি কিছু না।’
অ্যাপোলো-৮ এর চন্দ্রাভিযানের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বিশেষ প্রমাণ্যচিত্র তৈরি করছে বিবিসি রেডিও ৫। এ উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি দিচ্ছিলেন বিল অ্যান্ডার্স। এ সময় মহাকাশ সফরসঙ্গী ফ্রাঙ্ক বোরম্যানও তার সঙ্গে ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রীনিচ মান সময় আজ রাত আটটায় সম্প্রচারিত হওয়ার কথা রয়েছে।
মঙ্গলবার নাসার শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে লাল বর্ণের এই গ্রহে মানুষ পাঠানোর আগে মহাকাশ থেকে নির্গত মারাত্মক রেডিয়েশন, দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ও হাড়ের গঠনে কার্যকারিতা কমিয়ে যাওয়া প্রতিরোধে বিজ্ঞানীদের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
নাসার সাবেক নভোচারী টম জোনস। ২০০১ সালে অবসর নেয়ার আগে তিনি চারবার মহাকাশে পাড়ি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার প্রধান অন্তরায় হলো বাজেটের ঘাটতি। এ সমস্যা সমাধান করতে আরও ২৫ বছর লেগে যাবে।’
মঙ্গলে মানুষের পদচিহ্ন অঙ্কনের প্রধান বাধা হলো পৃধিবী থেকে এর বিশাল দূরত্ব। কোনো মহাকাশ যান মঙ্গলে পাড়ি দিতে হলে কমপক্ষে ২২৫ মিলিয়ন কিলোমিটার (২২ কোটি ৫০ লাখ কিলোমিটার) পথ অতিক্রম করতে হবে, যা ব্গিত মিশনগুলো থেকে অনেকগুণ বেশি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্তমান প্রযুক্তিতে নির্মিত রকেটে করে মঙ্গলে যেতে হলে নভোচারীর ৯ মাস সময় লেগে যাবে। তার মানে হলো মহাশূন্যের ওজনহীন স্থানে তাকে দীর্ঘসময় কাটাতে হবে। এত দীর্ঘসময় সেখানে কাটালে শরীরে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
উদারহণস্বরূপ, দীর্ঘসময় শূন্য অভিকর্ষে (জিরো গ্রাভিটি) কাটালে রেটিনায় রক্ত পরিবহন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে দেখা দিতে পারে দৃষ্টিহীনতা। এ ছাড়া হাড়ের ভরত্ব ও ক্যালসিয়াম সঙ্কুচিত হতে পারে।
টম জোনস বলেন, ‘এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হলে আমাদের বিদ্যমান রকেট প্রযুক্তি থেকে সরে আসতে হবে। এজন্য নিউক্লিয়ারভিত্তিক রকেট প্রযুক্তি চালু করতে হবে। যাতে করে খুব কম সময়ে মঙ্গলে পাড়ি দেয়া যায়। আর এটা করতে কমপক্ষে ২৫ বছর সময় লেগে যাবে।’
মঙ্গলে মানুষ আ-দৌ বসবাস করতে পারবে কি না-তা যাচাই করতে ২০২০ সালের মধ্যে মঙ্গলে নভোচারী পাঠাবে নাসা। ওই নভোচারী ফিরে আসার পর সবকিছু পুনর্বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে মহাকাশ সংস্থাটি।
সূত্র: বিবিসি
এসআর/জেআইএম