দিন দিন ধ্বংস হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববৈচিত্র। এখানে এক সময় খরগোশ দেখা যেত। দু’দশকে সেগুলো বিলুপ্ত হয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, নানা রঙের প্রজাপতিসহ অনেক পোকামাকড়ও বিদায় নিয়েছে। হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় অচিরেই যোগ হবে গুইসাপও। ঝোপঝাড়ে আগুন দিয়ে শেয়াল ও পাখির ব্যাঘাত ঘটানো হচ্ছে। বছরে মাত্র ৫ লাখ টাকার জন্য জলাশয়গুলো লিজ দিয়ে অতিথি পাখিদেরও তাড়ানো হচ্ছে। জীববৈচিত্র ধ্বংসের কারণগুলো জানাচ্ছেন আদীব আরিফ-
Advertisement
বিগত দুই বছরে ক্যাম্পাসে উল্লেখযোগ্যহারে গুইসাপের সংখ্যা কমে গেছে। ক্যাম্পাসের বন্যপ্রাণী গবেষকরা বলছেন, দ্রুত উদ্যোগ না নিলে শিগগিরই এটি ক্যাম্পাস থেকে হারিয়ে যাবে। গুইসাপের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলেন, ‘গুইসাপ কমে যাওয়ার প্রধান দুটি কারণ হলো- এর খাদ্য সংকট ও ডিম দেয়ার জায়গা ধ্বংস করা। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় উইপোকার যে ডিবি আছে এরা সেখানেই ডিম দিয়ে বাচ্চা দেয়। কিন্তু কিছু লোক উইপোকার ডিবিগুলো ভেঙে নিয়ে যায় মাছ ধরার জন্য। তাই এরা বংশবৃদ্ধি করতে পারছে না। অন্যটি হলো- বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। ক্যান্টিন ও ডাইনিংয়ের খাবারের উচ্ছিষ্ট নিয়ে দূরে ফেলে দেয়। ফলে এরা ফেলে দেয়া যে ভাত বা পঁচা তরকারি খাবার হিসেবে গ্রহণ করতো, সেটি পাচ্ছে না।’
> আরও পড়ুন- আমাদের পরিবেশ আমাদের ভবিষ্যৎ
গুইসাপের সাথে শেয়াল, ব্যাঙ ও অন্যান্য প্রাণীরও বাসস্থান হ্রাস পাচ্ছে। শীতকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ঝোপঝাড় বিশেষ করে, আলবেরুনী হলের পেছনের মাঠ, সুইমিং পুলের পেছনের মাঠ ও বঙ্গবন্ধু হলের পাশের মাঠের জঙ্গলগুলো আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়। ফলে শীতকালে বড় জঙ্গল কম থাকায় এখানে আশ্রয় নেয়া শেয়ালগুলো লুকানোর জায়গা পায় না। এছাড়া এসব মাঠে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ শীতনিদ্রায় যায়। কিন্তু ঝোপঝাড়গুলো পোড়ানোর ফলে সেখানে থাকা ব্যাঙগুলো পুড়ে মারা যাওয়াসহ বাসস্থানও ধ্বংস হচ্ছে। ঝোপঝাড়গুলো পোড়ানোর ফলে প্রজাপতি, ফড়িং, ঘাসফড়িংসহ নানা প্রজাতির পোকামাকড় বাসস্থানসহ পুড়ে মারা যাচ্ছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদরা বলেন, ‘ক্যাম্পাসে এ পর্যন্ত ১০৫ প্রজাতির প্রজাপতি আইডেন্টিফাই করলেও বর্তমানে এদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে, যা খুবই আশঙ্কাজনক। এছাড়া ফড়িং ও অন্যান্য পোকামাকড়ও বাসস্থান হারাচ্ছে। ঝোপঝাড়গুলো পোড়ানোর ফলে অসংখ্য কীটপতঙ্গ মারা যাচ্ছে।’
Advertisement
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের সীমানা প্রচীরের কারণে শেয়াল ক্যাম্পাস থেকে বিএলআরআইও ডেইরি ফার্মে যেতে পারছে না। যা তাদের খাদ্যগ্রহণে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। জীবন হুমকির মধ্যে থাকা পোটকা ব্যাঙের সবচেয়ে বড় পপুলেশনটির বাসস্থান ছিল কেন্দ্রীয় মসজিদের পেছনে সেলিম আল দীনের কবরের পাশে। কিন্তু সেখানে অস্থায়ী পার্কিং প্লেস করায় ব্যাঙগুলো ক্যাম্পাস থেকে হারিয়ে যেতে পারে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুতের লাইনগুলো ইনসুলেটর বিহীন হওয়ায় তা কলা বাদুরের জন্য মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌরঙ্গী থেকে মেডিকেল হয়ে আল বেরুনী পর্যন্ত বিদ্যুতের লাইনে বিগত তিন মাসে প্রায় ১০টিরও বেশি বাদুর মারা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুল হক বলেন, ‘ইনসুলিটরের তারের দাম অনেক বেশি হওয়ায় আমরা তা ব্যবহার করছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব লাইনই ইনসুলিটর বিহীন, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সিদ্ধান্ত।’
> আরও পড়ুন- ঝুঁকিতে হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ১২৪ প্রজাতির অতিথি পাখিও অবহেলিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখি বিচরণের লেকগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করছে না প্রশাসন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় জলাশয় জয়পাড়া জলাশয়টি পরিষ্কারের অভাবে সেখানে পাখি বসতে পারেনি। অন্যান্য জলাশয়ের মধ্যে পুরাণ কলার পাশে ও মেডিকেলের পেছনের লেকটি লিজ দেয়ার কারণে সেটিও পাখি বিচরণের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেটের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪টি জলাশয় লিজের আওতায় রেখে ৭টি জলাশয় পাখির জন্য লিজমুক্ত রাখা হয়েছে। এরমধ্যে বড় ৪টি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরে আয় ৪ লাখ ৮৯ হাজার। আর সবচেয়ে বড় জয়পাড়া জলাশয়টি পরিষ্কারের জন্য ৬ লাখ টাকা দরকার। তাই আমরা সেটি লিজের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম কিন্তু কেউ লিজ না নেয়ায় সেটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।’
এছাড়া দেশীয় ৭০টির বেশি প্রজাতির পাখি ক্যাম্পাসে নিয়মিত বাসা বেঁধে বাচ্চা দিয়ে থাকে। সেগুলোও মাঝে মাঝে ফটোগ্রাফার ও বিভিন্ন পেশার শিশুদের কবলে পতিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়গুলোতে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় বিশেষ করে ট্রান্সপোর্টের দু’পাশের জলাশয়ে দোকানগুলোর বর্জ্য, দর্শনার্থী ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন খাবারের প্যাকেট জলাশয়ে জমে পানির মান নষ্ট হয়ে খাবার সংকট তৈরি করছে। এছাড়া প্রতিবছর অতিথি পাখির জন্য জলাশয়গুলোতে বাঁশ ও জলজ উদ্ভিদ দিয়ে বিশেষ মাঁচা তৈরি করা হয়। যা গত দু’বছর থেকে তৈরি করা হচ্ছে না। জলাশয়গুলোর আশেপাশে দর্শনার্থীদের কোলাহল, গাড়ির হর্ন, মাইকিং ও পাখিদের লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রশাসনের নির্দেশনা থাকলেও দর্শনার্থীরা এসব মানছেন না।
Advertisement
> আরও পড়ুন- সুন্দরবনে বাড়ছে বাঘের সংখ্যা
ক্যাম্পাসের জীববৈচিত্রের সার্বিক অবস্থা নিয়ে বন্যপ্রাণী গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের সাথে জীববৈচিত্রেরর দিকেও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রতিটি স্থাপনা ও ভবন নির্মাণের আগে প্রশাসনের ইআইএ (ইনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) করানো উচিত। আর জলাশয়গুলো অতিথি পাখির জন্য পরিষ্কার করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে বনায়নের ক্ষেত্রে বিদেশি গাছ যেগুলো পরিবেশের ক্ষতি করে, তা বাদ দিয়ে দেশীয় প্রজাতির গাছ লাগানো উচিত।’
এসইউ/এমকেএইচ