তার হাতে রয়েছে সাতরকম ভেরিয়েশন। অফ স্পিন, লেগ ব্রেক, গুগলি, ক্যারাম বল, ফ্লিপার, টপ স্পিন এবং ব্যাটসম্যানের পায়ের পাতা লক্ষ্য করে দেয়া স্লাইডার আর্ম ইয়র্ক। কতরকম বৈচিত্র্যই না তার বোলিংয়ে। একের মধ্যে সাত- এমন একজন বোলারকেই তো চাই আইপিএলের মত জমজমাট ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের দলগুলোয়।
Advertisement
সুতরাং, ২০ লাখ রুপি না কত দাম তার সে দিকে তাকানোর ফুরসত নেই কারো। বরুন চক্রবর্তীকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেলো আইপিএলের প্রায় প্রতিটি ফ্রাঞ্চাইজির মধ্যে। কলকাতা নাইট রাইডার্সই প্রথম বরুনকে নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু তাকে ছাড়তে রাজি নয় অন্য কোনো ফ্রাঞ্চাইজিও। একে এক তাই বরুনকে নেয়ার দৌড়ে যোগ দেয় দিল্লি ক্যাপিটালস, চেন্নাই সুপার কিংস, কিংস ইলেভেন পঞ্জাব, রাজস্থান রয়্যালস। শেষ পর্যন্ত ৮.৪০ কোটি রুপিতে তাকে দলে ভেড়ায় প্রীতি জিনতার দল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব।
সাত ভ্যারিয়েশনের প্রতিটির মূল্যই ছাড়িয়ে ১ কোটি রুপির উপরে। নিজের বেজ প্রাইস থেকে ৪২ গুণ বেশিতে বিক্রয় হওয়া বিস্ময়কর এই স্পিনারকে নিয়ে তাই এখন পুরো ভারত সরগরম। এক মুহূর্তে কোটিপকি বনে যাওয়া বরুনকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে পুরো ভারতজুড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তো বরুনছাড়া যেন আর কথাই নেই।
ভারতের হয়ে তো কখনো খেলার কথাই নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটেও খুব একটা নামি-দামি ক্রিকেটার ছিলেন না তিনি। কিন্তু আইপিএল নিলামে হঠাৎ তামিলনাডুর স্পিনারের এমন চড়া মূল্যে বিকোনো নিয়েই তাই তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়ায়। রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সবাই। কারণ, নামটাই যে অধিকাংশের কাছে অজানা!
Advertisement
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জয়পুরে যখন আইপিএল নিলাম শুরু হয় বরুন চক্রবর্তী তার বাবা বিনোদ এবং মা মালিনি চক্রবর্তীর সঙ্গে নিজের বাড়িতে বসে টিভিতে দেখছিলেন। একসময় তার নাম উঠে আসে এবং শুরু হয় তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি। ২০ লাখ থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে সেটা গিয়ে পৌঁছালো ৮ কোটি ৪০ লাখ রুপিতে।
নিজেদেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না বরুনের। তারা মা-বাবার চোখ তো বিস্ফারিত। স্বপ্ন দেখছেন কি না, সেটাও নিশ্চিত হয়ে নেন। বুঝলেন, স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই তাদের ছেলে বরুন আইপিএলে বিস্মকরভাবে অভাবনীয় মূল্যে বিক্রি হয়েছেন। কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের ঝুলিতেই স্থান পেয়েছেন রহস্য স্পিনার বরুণ চক্রবর্তী।
ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বরুন বলেন, ‘গতকাল (মঙ্গলবার) সন্ধ্যা থেকে আমার ফোনটা এক মিনিটের জন্যও থামছে না। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে বাড়িতে বসে টিভিতে নিলাম দেখছিলাম। এটা ছিল একটি থ্রিলিং অভিজ্ঞতা। আইপিএলের নিলাম কিংবা খোদ আইপিএলে খেলা- সব কিছুই আমার কাছে নতুন এক অভিজ্ঞতা। এতটা মূল্য আমি মোটেও আশা করিনি। আশা ছিল, ভিত্তিমূল্য ২০ লাখ রুপি দিয়ে হয়তো কেউ কিনলেও কিনতে পারে আমাকে।’
কে এই বরুন চক্রবর্তী? হঠাৎ করেই কিভাবে এমন পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এলেন ২৭ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার? মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আইপিএল নিলামের পর এখন ভারতীয় ক্রিকেটে সবার মুখেই প্রশ্ন কে এই বরুন। কেনই বা এতটা আকাশচুম্বী উচ্চতায় তাকে টেনে আনা হলো? কি আছে তার মধ্যে?
Advertisement
তামিলনাড়ুর এই রহস্য স্পিনারের ক্রিকেটে হাতেখড়ি মাত্র ১৩ বছর বয়সে। কিন্তু ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা তিনি যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবে এগোয়নি। নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতেন।
কিন্তু বয়স ভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্টে সুযোগ না পেয়ে খেলা ছেড়ে পড়াশোনায় মন দেন বরুন। চেন্নাইয়ের এসআরএম ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেক্সারে পাঁচ বছরের কোর্স সমাপ্ত করেন। তার পর ফ্রিল্যান্স আর্কিটেক্ট হিসেবে কাজও শুরু করেন। পাশাপাশি চালিয়ে যান টেনিস বলের ক্রিকেট। এই টেনিস বল ক্রিকেটেই দ্রুত নাম করেন বরুন। চার দিকে তার নাম ছড়িয়েও পড়তে শুরু করে।
এর ফলেই কাজ ছেড়ে দিয়ে বরুন যোগ দেন ক্রমবেস্ট ক্রিকেট ক্লাবে। ওই সময় তিনি ছিলেন একজন পেস বোলার অলরাউন্ডার; কিন্তু হাঁটুর চোটের জন্য পেস বোলার থেকে হয়ে যান স্পিনার। তার স্পিনের বাইশ গজে বিব্রত হন ব্যাটসম্যানরা। সাতটি ভেরিয়েশনের জন্য তাকে ‘রহস্য স্পিনার’ বলতে শুরু করেন অনেকেই।
চোট সারিয়ে ওঠার পর চেন্নাই লিগের চতুর্থ ডিভিশন ক্লাব জুবলি ক্রিকেট ক্লাবে নাম লেখান তিনি। ২০১৭-১৮ মৌসুমে সাত ম্যাচে ৩১টি উইকেট নিয়ে সাড়া ফেলে দেন বরুণ। ওয়ানডে ফরম্যাটে তার ইকনমি রেট ৩.০৬। বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংয়ের হাতটাও বেশ ভালো তার।
টানা দু’বছর টিএনপিএলে সাফল্যের পর তামিলনাড়ু দলে ডাক পান বরুন। গত মাসে হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে রঞ্জিতে অভিষেক হয় এই রহস্য স্পিনারের। একটি মাত্র প্রথমশ্রেণির ম্যাচ খেললেও তামিলনাড়ুর হয়ে ৯টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। চলতি বছর বিজয় হাজারে ট্রফিতে দ্বিতীয় সেরা উইকেট শিকারী হন এই তামিল স্পিনার। বিজয় হাজারে ট্রফিতে নেন ২২টি উইকেট।
আইপিএলে প্রথমবার নাম উঠলেও, টুর্নামেন্টের সঙ্গে আগেই পরিচয় ঘটেছে বরুন চক্রবর্তীর। চেন্নাই সুপার কিংসের নেট বোলার হিসেবে বোলিং করেছেন বরু। সিএসকে-কেকেআর ম্যাচের আগে ধোনিদের নেটে বোলিং করার সময় নাইট অধিনায়ক দিনেশ কার্তিকেরও নজর আসেন তিনি।
এরপর কার্তিকই বরুনকে নাইটদের নেট বোলিং করার জন্য ডেকে নেন। এ নিয়ে বরুন বলেন, ‘নেটে ধোনি, রায়নাকে বোলিং করায় টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ব্যাটসম্যানদের মাইন্ডসেট বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তারপর দু’ সপ্তাহ ধরে নাইটদের নেটে বোলিং করেছি। সে সময় সুনিল নারিনের কোচ কার্ল ক্রো’র কাছে স্পিনের বেশ কিছু টিপসও পেয়েছি।’
বরুন চক্রবর্তীকে ভারতীয় ক্রিকেটে আগামীর তারকা বলেই মানছেন হরভজন সিং। টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘গতবছর সিএসকের নেটে তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তখনই মনে হয়েছে, এই বরুন চক্রবর্তী একদিন ভারতীয় দলের হয়ে খেলবে। নির্বাচকদের একটি চোখ তার ওপর রাখা উচিৎ। সে দ্রুত এবং ক্ষিপ্ত একজন স্পিন বোলার। সবচেয়ে বড় কথা, আরেকজন রহস্যময় স্পিনার।’
আইএইচএস/এমএস